মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের শুরু থেকে বর্তমান সময়ে অব্দি পৃথিবীতে বহু কালো অধ্যায় রচিত হয়েছে। মানব ইতিহাসের ভয়াবহ ঘটনাগুলোর মধ্যে কিছু কিছু মানুষের অন্তরআত্মা কাপিয়ে দেয়। হৃদয়বিদারক ঘটনায় যোগাযোগে প্রাণ হারিয়েছে কোটি কোটি মানুষ।
ঐতিহাসিক কাল থেকে ২৯২৩ সাল পর্যন্ত মানব ইতিহাসের ভয়াবহ ১০টি ঘটনা গুলোই তুলে ধরা হয়েছে এই আলোচনায়। সময় সময়ে মানুষ এবং প্রকৃতির কতটা ভয়ংকর হতে পারে তার বাস্তবিক ধারণা জানতে পারবেন এই লেখাতে।
মানব ইতিহাসের ভয়াবহ ১০টি ঘটনা
হত্যাযজ্ঞের পরিমাণ ও ভয়াবহতার বিচারে এই তালিকাটি প্রস্তুত করা হয়েছে। আজকের তালিকার ইতিহাসের ১০টি ভয়াবহ ঘটনা নিচে তুলে ধরা হলোঃ
(১) ৫৩৬ সাল- বেঁচে থাকার জন্য ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে বছর
মানব ইতিহাসের ভয়াবহ ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ৫৩৬ সালের অন্ধকার কুয়াশা। আনুমানিক ৫৩৬ সালে একটি বিশাল আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা ঘটেছিল। সেই আগ্নেয়গিরির সঠিক অবস্থান সম্পর্কে এখনও বিতর্ক রয়েছে। এর ফলে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে অনেক বেশি পরিমাণে ছাই এবং অ্যারোসল ছড়িয়ে পড়েছিল।
তখন একটি বড় অঞ্চল জুড়ে প্রায় দেড় বছর সেই ছাইয়ের অন্ধকারে ছেয়ে গিয়েছিল। ফলে তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিল ১.৫°-২° সেলসিয়াসে। বিরূপ আবহাওয়া, অতি শীতল পরিবেশের ফলে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়, দুর্ভিক্ষ হয় এবং পরিবেশ বেঁচে থাকার অনুপোযোগী হয়ে পড়ে। এ সময় কত মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল তা নির্ণয় করা যায়নি। ইতিহাসের সেই ভয়াবহ বছরটিকে ‘লেট এন্টিক লিটল আইস এজ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
(২) চেঙ্গিস খানের মোঙ্গল বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ
ঐতিহাসিক বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে চেঙ্গিস খান অন্যতম। চেঙ্গিস খান ছিলেন একজন মঙ্গোলীয় সামরিক নেতা। তার নেতৃত্বেই পৃথিবীর ইতিহাসের বৃহত্তম সাম্রাজ্য- মঙ্গোল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। তৎকালীন সময়ে সমগ্র পৃথিবীর প্রায় ১৭ ভাগ ছিল মঙ্গল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত।
মূলত চেঙ্গিস খানের সেই মঙ্গোল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পেছনে ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বর হত্যাযজ্ঞের একটি ঘটনা। আধিপত্য বিস্তারের জন্য চেঙ্গিস খানের মঙ্গোল বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিল পৃথিবীর প্রায় ৪ কোটি মানুষ। তৎকালীন সময়ে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ১১ ভাগ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এই হত্যাযজ্ঞে।
(৩) ট্রান্সআটলান্টিক স্লেভ ট্রেড (১৫-১৯ শতক)
ইউরোপীয় সাম্রাজ্যের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে এবং নিজেদেরকে অর্থনৈতিক শক্তির কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পশ্চিম আফ্রিকার বেসামরিক নাগরিকদের দাস করতে চাইতো। তারা তাদের ক্রীতদাসদের সঙ্কুচিত জাহাজে রাখতো এবং সমুদ্রের শোচনীয় অবস্থা সহ্য করতে বাধ্য করতো।
বেঁচে থাকার জন্য অনুপোযোগী সেই জাহাজগুলো ছিল সংকুচিত, খাবারের রেশন ছিল কম, ছিলনা স্যানিটারি ব্যবস্থা। ধারণা করা হয়, এই ধরনের মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডে মধ্য উত্তরণের সময় প্রায় ৬০ মিলিয়ন দাসের মৃত্যু হয়েছিল। মানব ইতিহাসের ভয়াবহ ও জঘন্য কর্মকাণ্ড হিসেবে এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা পরিচালিত হয়েছে প্রায় ৪০০ বছর ধরে। সর্বশেষ ১৮০৮ সালের ১ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রথাটি বিলুপ্ত হয়।
(৪) সালেমের ডাইনি (১৬৯২-১৬৯৩)
ঔপনিবেশিক ম্যাসাচুসেটসের সালেম গ্রামে, ১৬৯২ সালের জানুয়ারি মাসে দুটি অল্প বয়সী মেয়ে এক অচেনা রোগে আক্রান্ত হয়। উইলিয়াম গ্রিগস নামে একজন স্থানীয় ডাক্তার মেয়েদের এই রোগের উপসর্গকে জাদুকরী বলে নির্ণয় করেছিলেন। স্থানীয় অন্যান্য মেয়েদের মাঝেও অনুরূপ লক্ষণ প্রকাশিত হয় এবং চারিদিকে বলাবলি হতে থাকে মেয়েরা শয়তান দ্বারা আবিষ্ট হয়েছে।
কাল্পনিক এই প্রমাণের উপর ভিত্তি করে জাদুবিদ্যায় জড়িত নারী-পুরুষদের মধ্যে ২০০ জনেরও বেশি লোককে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। ১৬৯৩ সালের শুরুর দিকে এই বিচারকার্য শেষ হয় এবং ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। পরবর্তীতে উপনিবেশিক বিচারকগণ তাদের ভুল স্বীকার করে এবং যারা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছিল তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল। ১৯৭৬ সালে পুনরায় সেই অচেনা রোগের গবেষণাকালে সত্য উন্মোচিত হয়। সে অনুযায়ী, ফাঙ্গাস এর্গট বিষাক্ততার জন্যই মেয়েদের সেই লক্ষণগুলো দেখা দিয়েছিল।
(৫) কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার- জ্যাক দ্য রিপার (১৮৮৮)
ইংল্যান্ডের ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার ‘জ্যাক দ্য রিপার’ এর উত্থান হয়েছিল ১৮৮৮ সালে। প্রথমদিকে সে ইংল্যান্ডের পাঁচজন নারীর লাশ খুন ও বিকৃত করে রাজপথে সন্ত্রাসী হামলা শুরু করে। সে মেয়েদেরকে স্বীকার করে তাদের জরায়ু এবং কিডনির মতো অঙ্গ অপসারণ করে নিত। সে মেয়েদেরকে নির্মমভাবে ছুরিকাঘাত করার পর যেই অঙ্গ-বিচ্ছেদ চালিয়েছিল তা মূলত নারীদের প্রতি তার গভীর ঘৃণা প্রদর্শন করে।
কিন্তু নির্দিষ্ট একটি সময় পর জ্যাক দ্য রিপার তার হত্যাকাণ্ড বন্ধ করেছিল। বর্তমান সময়ে অবধি বিশ্বের সবচেয়ে কুখ্যাত সিরিয়াল কিলারের কোনো চিহ্ন ছাড়াই অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কারণ জানা যায়নি।
(৬) মানব চিড়িয়াখানা
মানব ইতিহাসের ভয়াবহ, জঘন্য, বর্বর ও নিষ্ঠুরতম ঘটনার মধ্যে অন্যতম ছিল মানব চিড়িয়াখানা বা Human Zoo। মানব চিড়িয়াখানায় প্রদর্শনের মূল বিষয়বস্তু ছিল আফ্রিকা থেকে আসা কালো বর্ণের মানুষ। এ সকল চিড়িয়াখানাগুলোতে প্রধান দর্শনার্থী ছিল পশ্চিমা বিশ্বের শ্বেত বর্ণের মানুষগন। মানুষের বাহ্যিক রূপকে ভিত্তি করে তারা কালো বর্ণের মানুষদের সাথে বন্য পশুর মতো আলো ব্যবহার করতো।
উনিশ শতকের শেষের দিকে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল মানব চিড়িয়াখানা। পরবর্তীতে সর্বপ্রথম হিটলার আকস্মিকভাবে মানব চিড়িয়াখানা নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ইতিহাসের সর্বশেষ মানব চিড়িয়াখানার প্রদর্শনী হয়েছিল বেলজিয়ামে ১৯৫৮ সালে।
(৭) পার্ল হারবার বিমান হামলা (১৯৪১)
১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর, জাপানিরা হাওয়াইতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌ ঘাঁটিতে একটি আশ্চর্যজনক বিমান হামলা চালায়। এর পূর্বে ১০ বছরে ক্রমাগতভাবে সম্পর্ক অবনতির জের ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের সাথে সমস্ত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের প্রতিপক্ষ চীনকে আর্থিক সহায়তা ও অন্যান্য সামগ্রী দিতে শুরু করে। ফলে জাপান এই হামলা চালায়।
এই আক্রমণের পর ২৩৩৫ জন সামরিক কর্মী প্রাণ হারিয়েছিল। আক্রমণের পরের দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পরবর্তীতে এই যুদ্ধই তাদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়।
(৮) হিরোশিমা-নাগাসাকি পারমাণবিক বোমা হামলা (১৯৪৫)
মানব ইতিহাসের ভয়াবহ একটি মর্মান্তিক ঘটনা ছিল জাপানের হিরোশিমা নাগাসাকি শহরে পারমাণবিক বোমা হামলা। ১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমা শহরে বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বোমা ফেলেছিল। এই আক্রমণে সেই শহরের ৯০%, অর্থাৎ প্রায় ৮০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল।
এই ঘটনার ৩ দিন পর নাগাসাকি শহরে আরেকটি বোমা হামলা করে। এতেও প্রায় ৪০ হাজার মানুষ নিহত হয়। জাপানি নাগরিকরা এখনও প্রতি বছর সেই নৃশংস সময়টিকে মনে ধারণ করে নিহতদের জন্য সম্মান প্রদর্শন করে।
(৯) চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিপর্যয় (১৯৮৬)
১৯৮৬ সালের ২৬ শে এপ্রিল চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪ নং পারমাণবিক চুল্লি আকস্মিক শক্তি বৃদ্ধির পর বিস্ফোরিত হয়। এর ফলে বিস্ফোরণের তেজস্ক্রিয় পদার্থ, পারমাণবিক উপাদান ও বিষাক্ত ধোঁয়া নির্গত হয়েছিল, যা বাতাসের মাধ্যমে ৬০ মাইল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল।
সেই ঘটনার বিপর্যয় এবং গাম্ভীর্য তাৎক্ষণিকভাবে দৃশ্যমান হয়নি। তবে পরবর্তীতে এই বিস্ফোরণের বিষাক্ততা ছড়িয়ে পড়েছিল সেই পারমাণবিক কেন্দ্রের চারদিকে। স্থানীয়দের মাঝে এর প্রভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিস্ফোরণের ৩৭ বছর পরেও, উচ্চ স্তরের গামা বিকিরণের কারনে চেরনোবিল বসবাসের অযোগ্য রয়েছে।
(১০) রুয়ান্ডায় গণহত্যা (১৯৯৪)
১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডার দুটি যুদ্ধরত উপজাতি- হুটুস এবং তুতসি, একে অপরকে আক্রমণ করেছিল। এ সময় আফ্রিকার সবচেয়ে জঘন্যতম গণহত্যা সংগঠিত হয়। এসময় হুতু নেতৃত্বাধীন সরকারকে উৎখাত করার প্রচেষ্টায় রুয়ান্ডার প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্টের অভ্যুত্থানের কারণে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে প্রায় ৫ লক্ষ থেকে ১ মিলিয়ন রুয়ান্ডাবাসীর মৃত্যু হয়েছিল এই গৃহযুদ্ধে।
আরো পড়ুন: পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া ৫০ অবাক করা ঘটনা
তিন মাস ধরে চলা সেই যুদ্ধে নৃশংসতা থেকে বেঁচে থাকা ব্যক্তিরাও নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল। বর্তমান সময়ে অবধি রুয়ান্ডাবাসীদের মধ্যে প্রবীনদের শরীরে যুদ্ধের শারীরিক ক্ষত এবং যন্ত্রণার ছাপ দেখা যায়।
শেষকথা
উপরোক্ত মানব ইতিহাসের ভয়াবহ ১০টি ঘটনার অধিকাংশই ঘটিয়েছিল নৃঃসংশ মানসিকতার মানুষেরা। তাদের ক্ষমতা এবং আধিপত্যের কাছে হেরে গিয়েছিল মানবতা। বর্তমান সময়েও বহু দেশে এমন হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে ক্ষমতাধররা। তবে কালের বিবর্তনে নির্যাতিতদের পাশাপাশি হারিয়ে যাবে জালেম সম্প্রদায়ও।
সম্মানিত ভিজিটর আমি নজরুল ইসলাম,পেশায় আমি একজন ব্লগ লেখক। প্রযুক্তি ও শিক্ষা, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং লাইফস্টাইল সম্পর্কে লেখাই আমার প্রিয়। এই ব্লগের মাধ্যমে আমি সঠিক তথ্য প্রদানের মাধ্যমে ভিজিটরদের সহযোগিতা করাই মূল লক্ষ্য।