অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা ভারতের দর্শনীয় স্থান সমূহ

বর্তমান পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম আয়তনের এবং দ্বিতীয় সর্বাধিক জনসংখ্যার দেশ ভারত। বিশাল এই দেশের একে প্রান্তে রয়েছে প্রকৃতির একেক রকম রূপ। ইতিহাস-ঐতিহ্য, অপরূপ প্রকৃতি, পাহাড়ি অঞ্চল, জলাভূমি-সমুদ্র, বন-জঙ্গল এবং নানান আধুনিক স্থাপনার সমন্বয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে হাজারো দর্শনীয় স্থান। অন্যদিকে, ২৮টি রাজ্য এবং ৮টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রতিটিতে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জলবায়ু, জাতিগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় কোটি মানুষের সমাগম হয় ভারতের দর্শনীয় স্থান সমূহে। 

ভারতের আগ্রার তাজমহল, কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, গোয়া, সিকিম, দার্জিলিং, কেরালা, কর্ণাটক প্রভৃতি স্থান বিশ্বব্যাপী পরিচিত। তবে এগুলোর বাইরে ও আরো অসংখ্য দর্শনীয় স্থান রয়েছে প্রকৃতির লীলাভূমি ভারতে। সেসকল অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা ভারতের দর্শনীয় স্থান সমূহ সম্পর্কে আকর্ষণীয় তথ্যগুলো তুলে ধরা হলো এই লেখাতে।

ভারতের বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান সমূহ 

ভারতের বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান
ভারতের বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান সমূহ 

ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত দর্শনীয় স্থানসমূহ এবং তাদের প্রাথমিক পরিচিতি সম্পর্কে নিচে তুলে ধরা হলো:

ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স (Valley of Flowers)

ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স ভারতের উত্তরাঞ্চলের উত্তরাখন্ডে প্রায় ১২,১০০ ফিট উচ্চতায় ৮৭ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত একটি অপরূপ সৌন্দর্যের ফুলের মাঠ। যোশিমঠ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ঘানঘারিয়া থেকে এই ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্সের এলাকা শুরু। এখানে প্রায় ৫২১ প্রজাতির লতা গুল্ম ও বৃক্ষের আবাসস্থল এবং প্রায় ৩০০ প্রজাতির রঙিন ফুল ফোটে এখানে। পার্বত্য বিরল প্রজাতির উদ্ভিদও দেখা যায় এখানে। সব মিলিয়ে এই ফুলের রাজ্যটি যে কারো মনের মধ্যে জায়গা করে নিতে সক্ষম।

কন্যাকুমারী (Kanyakumari)

কন্যাকুমারী ভারতবর্ষের মানচিত্রের শেষ বিন্দুতে তিন সাগরের মিলনক্ষেত্রে তামিলনাড়ু প্রদেশের অন্তর্গত। আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগরের ত্রিমাত্রিক মিলন হয়েছে এই কন্যাকুমারীতে। এখান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সৌন্দর্য অনবদ্য। এই স্থানটিকে জুড়ে রয়েছে স্বামী বিবেকানন্দের নানান স্মৃতি। এছাড়াও প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশের জন্যও এটি বিখ্যাত।

দুধপাথরি (Dudhpathori)

দুধপাথরি শ্রীনগর থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত প্রকৃতির এক আশ্চর্য লীলাভূমি। দুধপাথরি স্থানটি হিমালয় পর্বতমালার পীরপাঞ্জাল রেঞ্জে গামলার মতো এক উপত্যকা। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৯ হাজার ফুট উঁচুতে জম্মু ও কাশ্মীরের বুডগ্রাম জেলায় অবস্থিত। এখানে যেই পানি প্রবাহিত হয় তা দূর থেকে দেখলে দুধের মত সাদা মনে হয়। এর পাশাপাশি রয়েছে বিখ্যাত তুসানিদান ও নীলনাগ লেক। সেখানে প্রকৃতির যেন তার রঙের বাক্স উপর করে দিয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকছে সবুজ ঘাসের গালিচায়।

ইউসমার্গ (Yousmarg)

ইউসমার্গ ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর উপত্যকার পশ্চিমে ঝিলাম নদীর উপনদ, দুধ গঙ্গা নদীর তীরে বাডগাম জেলায় অবস্থিত একটি পাহাড়ি স্টেশন। এই স্থানটি তুষার পর্বতমালা এবং পাইন দ্বারা আবৃত। ইউসমার্গ বলতে জাদুঘরকে বোঝানো হয়। স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন যে, যীশু কাশ্মীরে এসেছিল এবং ইউসমার্গে অবস্থান করেছিল। চারিদিকে পাইন গাছের সার, বড় বড় পাহাড়, মাঠে চড়ানো ঘোড়া যেন প্রকৃতির অপরূপ ও নিবিড় মিলন সাধন করেছে এখানে।

ডুয়ার্স (Duers)

ডুয়ার্স ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে শিলিগুড়ি শহর থেকে সামান্য দূরে ভূটান সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত অসাধারন একটি ট্রাভেল ডেস্টিনেশন। ডুয়ার্স অর্থ দুয়ার বা দরজা। এটি পশ্চিম্বঙ্গ রাজ্য ও আসাম রাজ্যের সংলগ্ন এলাকায় এবং পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত। এখানে রয়েছে ছোট বড় পাহাড় এবং পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তায় এসে মিশেছে দূরের পাহাড়। এই এলাকার নিঝুম-নিরিবিলি পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি শাল ও সেগুন গাছ। 

নাগাল্যান্ড (Nagaland)

নাগাল্যান্ড ভারতের দূর্গম পাহাড়ি পথ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনাবিল শান্তিময় স্থান। ভারতের মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা, মনিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল -কে একত্রে বলা হয় সেভেন সিস্টার্স। তআর মধ্যে অন্যতম একটি হলো নাগাল্যান্ড। এখানের পাহাড়ে রয়েছে সবুজের বিস্ময়কর গালিচা, রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চার আর নানা উপজাতীয় সংস্কৃতি। এই পর্যটন কেন্দ্রটি প্রকৃতির প্রতি আপনার ভালোবাসা বহুগুনে বৃদ্ধি করবে।

কোদাইকানাল (Kodaikanal)

কোদাইকানাল ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের দিন্দিগাল জেলার পশ্চিমঘাট পর্বত মালার ছোট্ট একটি পাহাড়ি শহর। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। এই শহরের গোড়াপত্তন হয়েছিল ১৮৪৫ সালে। এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান আয়ের উৎস পর্যটন। সারা বছরই এখানে লেগে থাকে গলায় ক্যামেরা ঝুলানো টুরিস্টদের ভিড়। এই অঞ্চলের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে কোদাই লেক। মূলত এটিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল কোদাইকানাল পর্যটন কেন্দ্রটি।

লাক্ষাদ্বীপ (Lakshadweep)

লাক্ষাদ্বীপ ভারতের পশ্চিম দিকে কেরালা মালাবার উপকূল থেকে প্রায় ৩২৪ কিলোমিটার দূরে ছোট ছোট ৩৬ টি প্রবাল দ্বীপ নিয়ে গঠিত। এর আয়তন প্রায় ৩২ বর্গ কিলোমিটার। এটি ভারতের সবচেয়ে ক্ষুদ্র ইউনিয়ন টেরিটরি। ৩৬ টি দ্বীপের মধ্যে জনবসতি রয়েছে ১০টি দ্বীপে। অন্যান্য দিকগুলোতে বিভিন্ন হোটেল, রিসোর্ট এবং ট্যুরিস্ট ক্যাম্প গড়ে তুলেছে ইন্ডিয়ান ট্যুরিজম কর্পোরেশন এবং প্রাইভেট পর্যটন কোম্পানি। দ্বীপপুঞ্জের প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ঘেরা এই স্থানটি দেখতে প্রতিবছর অসংখ্য পর্যটকদের আগমন হয়।

পাটনিটপ (Patnitop)

পাটনিটপ ভারতের কাশ্মীর প্রদেশে জম্মু থেকে ১১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি হিল স্টেশন। এর কাছেই রয়েছে আকর্ষণীয় কিছু স্থানসমূহ, যেমন- স্কেটিং গার্ডেন, চিনার গার্ডেন ইত্যাদি। পাটনিটপ সবুজের অবাক করা ছায়াবন, পাইনে ঘেরা শোভিত পাহাড় ও পাহাড়, মেঘ, আকাশের অপরূপ লীলাখেলা। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখানে পাবেন প্যারা গ্লাইডিং করার ব্যবস্থা। তাই ভারত বা কাশ্মীর ভ্রমণের জন্য অন্যতম স্থান হিসেবে এটি বেছে নিতে পারেন।

লাইটলুম গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন (Lightloom Grand Canyon)

লাইটলুম গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ের স্মিথ গ্রামের কাছাকাছি অবস্থিত একটি অসাধারণ ভিউ পয়েন্ট। এটি শিলং শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখানে দিনব্যাপি চলে মেঘেদের আনাগোনা। শিলং এর সবচেয়ে উঁচু স্থান হওয়ায় একে জিরো পয়েন্টও বলা হয়। এখানে যাওয়ার পথে রাস্তার দুপাশে দেখা যায় ধাপ চাষের সোনালি ক্ষেত, সবুজ ধান খেত, নানা রঙের বনো ফুল, সাদা ছোট জংলি ফুলের কার্পেট ও অসাধারণ সৌন্দর্যমন্ডিত ঝর্ণা। এখান থেকে নিজেকে মেঘের ভেলায় ভাসিয়ে রাখার উপলব্ধি করা যায়।

আরু ভ্যালি (Aru Valley)

আরু ভ্যালি কাশ্মীরের পেহেলগাঁওন থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি ছোট গ্রাম। এই স্থানটি মূলত হ্রদ এবং পর্বতের অপরূপ সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। শীতকালে যখন তুষারপাত হয় তখন এখানে স্কেটিংয়ের জন্য প্রচুর পর্যটকদের সমাগম হয়। শীতকালীন সময়ে বরফে ঢাকা এই অঞ্চলের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য আকর্ষণ করে যে কাউকেই। অন্যদিকে, গরমকালে সেখানে উপভোগ করা যায় প্রকৃতির সবুজ রূপ। এখান থেকে উপভোগ করতে পারবেন ঘোড়ায় চড়া, হিমবাহ ইত্যাদি।

দাওয়াইপানি (Daoyaipani)

ভারতের দার্জিলিংয়ের হিমালয়ের করে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোড়ানো শান্ত ও নিরিবিলি একটি পাহাড়ি গ্রামের নাম দাওয়াইপানি। এটি প্রায় ৬,৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত একটি অদ্ভুত সুন্দর গ্রাম। এই গ্রামের প্রতিটি বাড়ি এবং প্রতিটি বাগ থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপব বৈচিত্র দেখতে পাওয়া যায়। ফটোগ্রাফারদের জন্য এটি একটি আদর্শ স্থান। প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এখানে আছে পাহাড়ে চড়ার সুযোগ, জানা অজানা বিচিত্র নানান পাখি, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের অসাধারণ দৃশ্য, নামচি ও চারধাম দেখার সুযোগ ইত্যাদি।

গোচেলা/ গোয়েচালা ট্রেক (Gochela/ Goechala Trek)

গোচেলা ট্রেক বর্তমানে পশ্চিম সিকিমের একটি জনপ্রিয় ট্রেক রুট। এই ট্রেক রুটে ইয়ুকসাম থেকে শুরু করে সাচেন, সোখা, জোংরি, থানসিং, লামুনে, গোয়েচালা/ গোচেলায় গিয়ে শেষ হবে। ট্রেকের পথে পড়বে কাঞ্চনজঙ্ঘা ন্যাশনাল পার্ক। গোচেলা ভিউ পয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য অপরূপভাবে দৃশ্যমান হয়। এই ট্রেকে সবুজে সমারোহ পেরিয়ে একটু উপরে উঠলেই দেখা মিলবে তুষার রাজ্যের।

আউলি (Auli)

আউলি ভারতের উত্তরাখন্ডে ২,৮০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত একটি হিল স্টেশন। এখানে উত্তরাখন্ডের নীলকন্ঠ, মানা পর্বত, নন্দা দেবীর ধবল শিখর এবং বরফে মোড়া পাহাড়ের বিভিন্ন নান্দনিক অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ রয়েছে। এটি বিশেষ করে শীতকালেই পর্যটকদের কাছে বেশি পছন্দের স্থান। বরফের সময় স্কিইং করতে পারবেন মাত্র ৫০০ টাকা খরচ করেই। আউলির অন্যতম প্রধান আকর্ষন এখানকার ক্যাবল কার। ক্যাবল কারে করে উপরে উঠতে থাকলেই দেখতে পাবেন নন্দাদেবী, দ্রোণাগিরি, নন্দাকোট, ত্রিশূল, পঞ্চচুল্লি ইত্যাদি একের পর এক পাহাড়ি ভিউ।

রোথাং পাস (Rothang Pass)

শিমলা থেকে মানালী যাওয়ার পথে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৩,৫০০ ফুট উপরে অবস্থিত একটি আকর্ষনীয় রাস্তা রোথাং পাস ট্রিপ। রোথাং পাস ট্রিপের রাস্তা মে মাসের মাঝামাঝি থেকে খুলে এবং নভেম্বর মাস পর্যন্ত খোলা থাকে। শীতকালে তুষারপাতের জন্য এই রাস্তাটি বন্ধ থাকে। মানালী এবং রোথাং পাস যাওয়ার এন্ট্রি পয়েন্ট হলো কোথি। মানালী থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে কেইলং লেহ জাতীয় সড়কপথে কোথি, গুলাবা ভ্যালি, মারহি হয়ে পৌছানো যায় রোথাং পাস পয়েন্টে। শীতকালে এখানে বরফে স্তি, স্নো বাইকিং, প্যারাগ্লাইডিং এবং অন্যান্য অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ রয়েছে। 

হর কি দুন ট্রেক (Har Ki Dun Trek)

হর কি দুন ট্রেক ভারতের উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশী রাজ্যের গাড়োয়াল হিমালয়ের পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত সবচেয়ে পুরানো ট্রেকিংগুলোর একটি। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩,৫৬৬ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। শীত এবং গ্রীষ্ম উভয় সিজনেই এখানে ভ্রমণে যাওয়া যায়। এই ট্রাকিং এর পাশেই রয়েছে স্বর্গরোহিনী পর্বতমালা। এই ট্রেকিং এর সমস্ত পথ জুড়ে রয়েছে পাইন জঙ্গলের নিস্তব্ধতা। শীতকালে থাকে বরফাবৃত গাছপালা এবং গ্রীষ্মকালে থাকে সবুজ উপত্যকার রূপবৈচিত্র্য। এই ট্রেকের পথেই দেখতে পাবেন প্রায় ২,০০০ বছর পুরনো কয়েকটি গ্রাম।

কল্পা (Kalpa)

কল্পা হিমাচল প্রদেশের এক কল্পলোকের নাম। কিন্নর কৈলাস পর্বতমালার ঘেরাটোপে কল্পার অবস্থান। এখানে প্রকৃতির তার আপন খেলে ছবি এঁকেছে কলপাড় ক্যানভাসে। কল্পাকে কিন্নরিদের দেশও বলা হয়। এখানের গোল্ডেন আপেলের খ্যাতি রয়েছে বিশ্বব্যাপী। শীতে এখানে প্রচন্ড তুষারপাত হয়। ছোট এই শহরের মাথার উপর দিয়ে চোখে ভেসে আসে বরফে মোড়া পাহাড়ের চূড়া। এখানে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথের দুপাশে রয়েছে পাইন গাছের গভীর বন। এখানে ঘরবাড়ি কাঠের তৈরি এবং স্থানীয়দের আতিথেয়তা মুগ্ধ করে সকলকেই।

লাচুং (Lachung)

লাচুং ভারতের নর্থ সিকিমের ৯,৬০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত একটি অপরূপ সুন্দর গ্রাম। গ্যাংটক থেকে লাচুং পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রকৃতির অপরূপ শোভা, যা লাচুং আসার পথের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে দেখতে পাবেন। এখানের জনবসতি খুবই কম এবং পাহাড় ও বনভূমি নিঝুম। চারিদিকে রয়েছে আকাশছোঁয়া পাইন, ফার আর ধূপগাছের সারি। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে হাজার রকমের প্রজাপতি এবং পাশেই বয়ে চলেছে তিস্তা নদী। প্রকৃতির নৈসঃর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য এটি একটি আদর্শ স্থান।

তাওয়াং (Tawang)

অরুণাচল প্রদেশের তাওয়াং এলাকার সৌন্দর্য রীতিমতো চোখ ধাঁধাঁনো। সেই তুলনায় সেখানকার পর্যটকের উপস্থিতি এখনো ব্যাপক নয়। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে এই প্রদেশে প্রবেশের ব্যাপারে বিধি-নিষেধ। সেখানে পৌঁছাতে পর্যটকদের একটি বিশেষ ‘ইনার লাইন পারমিট’ নিতে হয়। সবকিছুর পর স্থানটিতে পৌঁছেই আপনি মুগ্ধ হয়ে যাবেন। সেখানকার অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য আপনার সব ক্লান্তি মুছে দেবে।

চেরাপুঞ্জি ও মাওসিনরাম (Cherrapunji and Maosinram)

পর্যটন নগরী ও মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলং থেকে প্রায় ৫৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চেরাপুঞ্জি ও মাওসীনরাম বিশ্বের সবচেয়ে আর্দ্র স্থান হিসেবে পরিচিত। রেকর্ডপত্র ঘাটলে জানতে পারবেন, এই দুটি স্থানে প্রতিবছর ৪৫০ ইঞ্চিরও বেশি বৃষ্টিপাত হয়। চেরাপুঞ্জি ও মাওসীনরামের অসাধারণ সব প্রাকৃতিক দৃশ্য আপনার চোখে মুগ্ধতার পরশ বুলিয়ে দেবে। জায়গা দুটির পাহাড়গুলোতে আছে বেশ কয়েকটি ট্রেকিং রুট।

ভার্সে (Verse)

ভার্সে হলো পশ্চিম সিকিমের একটি বিখ্যাত ট্রেকিং গন্তব্য। এই স্থানটি ভারত এবং নেপালের প্রাকৃতিক সীমারেখা তৈরি করেছে। এই ভার্সের প্রধান পরিচয় এখানে থাকা ভারসে রডোডেনড্রন স্যাংচুয়ারি, যা ১০৪ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত একটি সীমান্তবর্তী এলাকা। এই স্থানটি প্রায় ১০,০০০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত। পরিষ্কার আকাশ থাকলে এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় স্পষ্ট ভাবে। পাশেই রয়েছে গুরাসতাল। 

শিলং (Shillong)

উত্তর-পূর্ব ভারতের এক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি শিলং নগরীও পর্যটকদের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত। প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড নামেও পরিচিত এই নগরী। ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ভ্রমণ গন্তব্যগুলোর একটি হলো শিলং। শিলং থেকে একটি কার রিজার্ভ করে কিংবা পাবলিক বাসে করে যেতে পারেন আসামের প্রধান শহর গুয়াহাটিতে। আঁকাবাাঁকা ও সর্পিল রাস্তা আর নজরকাড়া প্রাকৃতিক দৃশ্য আপনাকে উপহার দেবে এক চমৎকার স্মৃতি।

সিকিম (Sikkim)

সিকিম ভারতের উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্য, যা প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে অপরূপ গন্তব্যের স্থান। সিকিমের দক্ষিণ দিকে ঘিরে আছে পশ্চিমবঙ্গ, দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ভুটান, পশ্চিম দিকে নেপাল এবং উত্তর-পূর্ব দিকে চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল তিব্বত। সিকিমের মোট আয়তন প্রায় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এবং এর মোট জনসংখ্যা প্রায় ৬ লক্ষেরও বেশি। সিকিম রাজ্যটি পর্যটন প্রেমীদের জন্য সুন্দর পাহাড়, গভীর উপত্যকা এবং জীববৈচিত্র্যে ভরা একটি নান্দনিক স্থান।

গেজিং (Gauging)

গেজিং হলো প্রায় ৫,৬০০ ফুট উচ্চতায় পশ্চিম সিকিমের ছোট্ট একটি জেলা শহর। গেজিংয়ে ঘুরতে আসা মানে, ঘরে বসে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপবৈচিত্র উপভোগ করা। এখানে চোখের সামনেই দেখতে পাবেন মেঘের উপত্যকা এবং চারিদিকে থাকবে পাহাড়ি নিস্তব্ধতা। প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য রয়েছে পাহাড়ি জনপদ। মাথার উপরে মেঘের ঢেউ খেলানো মিহী পর্দার নিচে শিশিরে শিক্ত হওয়ার জন্য অন্যতম স্থান গেজিং। সন্ধ্যাবেলায় দেখা যায় সূর্যাস্তের লাল আভা এবং রাতের আকাশ থাকে তারকাশোভিত রূপে প্রস্ফুটিত।

আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ (Andaman Islands)

বঙ্গোপসাগরের উপরে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিক বরাবর ৫৭২ টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত হয়েছে আন্দামান ও নিকোবর আইল্যান্ড। উত্তর দিকের কিছু দ্বীপ নিয়ে গঠিত হয়েছে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ। সাধারণ পর্যটকদের ক্ষেত্রে নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ভ্রমণের ক্ষেত্রে সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তাই ভ্রমণের জন্য আন্দামান দ্বীপপুঞ্জই উন্মুক্ত। চারিদিকে নীল জলরাশি এবং তার মাঝে জেগে উঠেছে স্থল ভূমি। আশেপাশে রয়েছে পাহাড়ি অরণ্য আর রুপালি বালুকাবেলা। নারকেল গাছের ছায়ায় এই দ্বীপপুঞ্জে দেখতে পাওয়া যায় বহু হরিণ। হাত বাড়ালি ধরতে পারা যায় না নানান ধরনের রঙিন মাছ ও সামুদ্রিক প্রবাল।

পেহেলগাম (Pehelgam)

পেহেলগাম জম্মু-কাশ্মীর প্রদেশের অনন্তনাগ জেলার অন্তর্গত। এই স্থানটিকে এশিয়ার সুইজারল্যান্ড নামেও অভিহিত করা হয়। আনুমানিক ১,৭০০ সালের দিকে সম্রাট আওরঙ্গজেব এই অনন্তনাগ স্থানটির নাম রেখেছিলেন ইসলামাবাদ। ডিসেম্বর মাস থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বরফে ঢাকা থাকে এই এলাকায় সবকিছুই। এছাড়া বছরের বাকি মাসগুলোতে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় দেখা যায় এখানে। এই স্থানের অর্থকরী ফসল উৎপাদনের মধ্যে আপেল ও জাফরান অন্যতম। পেহেলগামের রাস্তার দুপাশে দেখতে পাওয়া যায় এসকল ফলের বাগান এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।

গুলমার্গ (Gulmarg)

গুলমার্গ জম্মু-কাশ্মীর ইউনিয়ন টেরিটোরির কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর থেকে ৫২ কিলোমিটার দূরে ৮,৮২৫ ফুট উচ্চতায় বারীমুলা জেলার অন্তর্গত একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত স্থান। এটি পাকিস্তানের সীমান্ত থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, যা ‘Taj of কাশ্মির’ নামেও পরিচিত। গরমের সময়ে এখানে মানুষ আসেন ঠান্ডা আবহাওয়ায় সময় কাটাতে। তেমনি শীতের সময়েও থাকে বরফে ঢাকা পরিবেশ। পীরপঞ্জাল রেঞ্জে অবস্থিত এই হিল স্টেশনে বছরব্যাপী দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেই থাকে।

তাকদা (Takda)

তাকদা দার্জিলিংয়ের মূল শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে উত্তরবঙ্গের গ্রামীন পর্যটনের সেরা স্থানগুলোর মধ্যে একটি। এখানে রয়েছে দিগন্তবিস্তৃত ঘন সবুজের সমারোহ এবং বিখ্যাত চা বাগান। চারিদিকে রয়েছে অপূর্ব নৈস্বর্গিক শোভা। পাহাড়ের কোলে সবুজের সমারোহে ঘেরা এই পর্যটন গন্তব্যটি অনেকের কাছেই এখনও অপরিচিত। তবে জনবহুল পর্যটন কেন্দ্রগুলো থেকে এখানে ভ্রমণ করলে পাবেন প্রকৃতির নিবিড় সৌন্দর্যের স্পর্শ।

আগরতলা (Agartala)

ছোট একটি শহরে বসবাসের আনন্দ কেমন তা জানতে হলে আপনাকে ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় যেতে হবে। শহরটি বিভিন্ন প্রাসাদ, মন্দির ও সেগুলোর সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের জন্য সুপরিচিত। এছাড়া হাতে তৈরি বস্ত্রশিল্প ও বাঁশের তৈরি হস্তশিল্পের জন্যও বিখ্যাত আগরতলা। সেখানকার বাহারি সব স্থানীয় খাবারও বিখ্যাত।

সাজং (Sajang)

সাজং হলো সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক থেকে মাত্র ২৪ কিলোমিটার দূরে পূর্ব সিকিমে অবস্থিত ছোট্ট একটি গ্রাম। বর্তমানে এটি অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। হিমালয়ের কোলে অনন্য রূপে সেজেছে এই গ্রামটি। স্থানীয়রা অধিকাংশ সময় জুড়ে ব্যস্ত থাকে তাদের কৃষি কাজ নিয়ে। পাহাড়ি সৌন্দর্যে তাদের কৃষিকাজের রুপচিত্র এবং স্থানীয় নদীর হিমশীতল জলে একটু সাঁতার কেটে আসা মুগ্ধ করে সকল পর্যটকদের।

লাচেন (Lachen)

লাচেন হলো ভারতের ৩৬ টি হেরিটেজ ভিলেজ এর মধ্যে একটি, যা উত্তর সিকিমের পাহাড়ে অবস্থিত। এটি সিকিমের রাজধানী থেকে ১২৬ কিলোমিটার দূরে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯,৪০০ ফিট উপরে অবস্থিত। এই গ্রামটি নিজস্ব প্রশাসন ব্যবস্থাও রয়েছে। গ্রামটির জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হলো এর অপরূপ সুন্দর গুরুদোঃমার লেক। সেখানে যেতে পথের ধারে দেখতে পাবেন সবুজ কর্নিফার এবং লাল, গোলাপি, বেগুনী রঙের রডোডেনড্রন।

আরও পড়ুন: মানব ইতিহাসের ভয়াবহ ১০টি ঘটনা 

মাজুলি (Majuli)

মাজুলি হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র নদীর একটি দৃষ্টিনন্দন দ্বীপ। যেখান থেকে ফেরি বোটে চড়ে আসামের যোরহাট নগরীতে যাওয়া যায়। বিপুল পরিমাণ পলিমাটি সরে যাওয়ার কারণে চমৎকার এ দ্বীপটি ক্রমেই ছোট হয়ে যাচ্ছে। মাজুলি ভ্রমণ করতে হলে আপনাকে হয় একটি মটর বোট রিজার্ভ করতে হবে নতুবা স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে ফেরিতে চড়তে হবে। এই স্থানেও বেশি পর্যটক দেখা যায় না। তাই নিরিবিলি সময় কাটাতে চাইলে যেতে পারেন মাজুলি ভ্রমণে।

মনিপুর (Manipur)

মনিপুরের আদুরে নাম হলো ‘সুইজারল্যান্ড অব ইন্ডিয়া’। রাজ্যটির অবস্থান উত্তর-পূর্ব ভারতের একেবারে উত্তর-পূর্ব কোণায়। বন্যপ্রাণি, চিত্তাকর্ষক প্রাকৃতিক দৃশ্য, ভাসমান সব দ্বীপরাজি, স্থানীয় বাসিন্দাদের উষ্ণ আতিথেয়তা সবকিছুই আপনার মনে প্রথম দেখাতে ভালোলাগার অনুভূতি এনে দেবে। উত্তরে নাগাল্যান্ড, পশ্চিমে আসাম, দক্ষিণে মিজোরাম ও পূর্বে মিয়ানমার দ্বারা বেষ্টিত মনিপুর।

শেষকথা

উপরে উল্লেখিত ভারতের দর্শনীয় স্থান সমূহ ছাড়াও আরো বহু পর্যটনকেন্দ্র এবং ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো রয়েছে। তবে এই আলোচনা শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থানগুলোই তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে স্বল্প খরচেই প্রতিবেশী এই দেশটিতে একসাথে বিশ্বের সকল প্রান্তের রূপ, রং ও স্বাদ উপভোগ করতে পারবেন।

Scroll to Top