বাংলাদেশের রহস্যময় ও ভয়ংকর স্থানসমূহ

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে থাকা অজানা তথ্যের রহস্যময় ঘটনা ও ভয়ংকর ভূতুরে স্থানগুলো সম্পর্কে মানুষের কৌতূহল রয়েছে বরাবরই। অজানাকে জানতে বহু এ্যাডভেঞ্জার প্রেমী মানুষের বিচরণ হচ্ছে বাংলাদেশের রহস্যময় ও ভয়ংকর স্থানসমূহে। 

বাংলাদেশের রহস্যময় ও ভয়ংকর স্থানসমূহ রয়েছে অনেক, যা অত্যন্ত ভয়ংকর ও ভৌতিক। অতীতে, শত শত বছর পূর্বে বাংলার বুকে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অমীমাংসিত ঘটনা রূপকথার গল্পের ভিত্তিতে বর্তমান সময় অবধি চলে এসেছে। সেই রহস্যময় স্থান গুলো কি কি, কি আছে সেই স্থানগুলোতে, সেখানে কি-ইবা হয়েছিল অতীতে? এমন সব আকস্মিক ও অবাক করা তথ্য জানতে পারবেন এই লেখা থেকে।

লালবাগ কেল্লার সূড়ঙ্গ (Tunnel of Lalbagh Fort)

লালবাগ কেল্লা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে অবস্থিত একটি বিস্ময়কর ও সৌন্দর্য্যমন্ডিত ঐতিহাসিক স্থান। ঐতিহাসিক তথ্য মতে, ১৬৭৮ সালে  যুবরাজ আযম শাহ লালবাগ কেল্লার দুর্গের কাজ শুরু করে। কিন্তু পরের বছর যুবরাজ আযম শাহ দিল্লিতে চলে যাওয়ায়, শায়েস্তা খাঁ -কে দূর্গের অসমাপ্ত কাজটি বুঝিয়ে দিয়ে সেটা নির্মাণ সমাপ্ত করার অনুরোধ করেন। 

শায়েস্তা খাঁ যুবরাজের নকশা অনুযায়ী দূর্গের কাজ করতে থাকলে রহস্যজনক ভাবে ১৬৮৪ সালে তার অতি আদরের মেয়ে ‘পরিবিবি’ মৃত্যুবরণ করেন। এর ফলে দুর্গটি অশুভ মনে করে শায়েস্তা খাঁ দুর্গের কাজ বন্ধ করে তার পরিবর্তে চিত্তাকার্ষ পরিবিবি স্মৃতিসৌধ তৈরি করেছিলেন।

বাংলাদেশের রহস্যময় ও ভয়ংকর স্থানসমূহ

লালবাগ কেল্লার একটি ভবনের নাম পরিবিবি স্মৃতিসৌধ। কিন্তু কেল্লায় আরো বহু অসমাপ্ত অংশ রয়েছে। সেই অংশের সূড়ঙ্গগুলো বর্তমানে পর্যটকদের কাছে বাংলাদেশের রহস্যময় ও ভয়ংকর স্থানসমূহের একটি হয়ে উঠেছে। পর্যটকদের অনেকের মতে, লালবাগ কেল্লায় এমন একটি সুরঙ্গ আছে যার ভিতরে কেউ প্রবেশ করলে আর ফিরে আসতে পারে না। কথিত আছে, একবার সেই সুড়ঙ্গে দুটি কুকুর পাঠালে তারা আর ফিরে আসেনি। পরবর্তীতে আবারও শিকল বেঁধে কুকুর পাঠানো হলে, শুধু শিকলগুলো ফেরত আনা গিয়েছে। 

অনেকের মতে, ঐতিহাসিক সেই সুড়ঙ্গের মধ্যে অনেক শক্তিশালী গ্যাস সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে কেউ প্রবেশ করলেই তার হাড়, মাংস গলে যায়। কেউ কেউ ভাবেন সেখানে ভয়ঙ্কর কোন শক্তি আছে। সেই সুড়ঙ্গটি এতটাই গভীর যে সেখানে টর্চ লাইটের আলোও অন্ধকার ভেদ করতে পারেনা। বর্তমানে রহস্যজনক ও ভয়ঙ্কর সেই সুড়ঙ্গটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ।

বগাকাইন হ্রদ (Bogakain Lake)

বগা লেক বা বগাকাইন হ্রদ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উচ্চতার একটি স্বাদু পানির হ্রদ। এটি বান্দরবান জেলা শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে রুমা উপজেলার কেওকারাডং পর্বতের গা ঘেষে অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই হ্রদ এর উচ্চতা প্রায় ১,২৪৬ ফুট (৩৮০ মিটার)। ফানেল আকৃতির আরেকটি ছোট পাহাড়ের চুড়ায়, বগা হ্রদের গঠন অনেকটা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের মতো অদ্ভুত।

এই লেকের আশেপাশে বসবাসকারী ‘বম’ উপজাতিরা বিশ্বাস করে বহুকাল পূর্বে এখানে ছোট ছোট বাচ্চাদের খেয়ে ফেলা ড্রাগন বাস করতো। তৎকালীন স্থানীয়রা নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে সেই ড্রাগনকে হত্যা করলে ড্রাগনের মুখ থেকে প্রচন্ড আগুন নির্গত হয়ে পাহাড়কে বিস্ফোরিত করে, আর তা থেকেই বগা লেক জন্ম নেয়। বগা শব্দটি ‘বম’ ভাষার, যার অর্থ ড্রাগন। রুমা উপজেলা পরিষদের সাইনবোর্ডে বগাকাইন হ্রদ -এর এমন রহস্যময় তথ্যই লেখা রয়েছে। এখনো পর্যন্ত বগা লেক এর গভীরতা নির্ণয় করা যায়নি। প্রতিবছর এক অজানা কারণে এখানের পানির রং বদলে যাওয়া আজও রহস্যময় হয়েই রয়েছে।

জ্বীনের মসজিদ (Jinn’s Mosque)

জ্বীনের মসজিদ বাংলাদেশের রহস্যময় ও ভয়ংকর স্থানসমূহের একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। এটি বাংলাদেশের লক্ষীপুর জেলার রায়পুর উপজেলায় দেনায়াতপুর নামক স্থানে অবস্থিত। এই মসজিদটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাওলানা আব্দুল্লাহ। ১৮৮৮ সালে প্রায় ৫৭ শতাংশ জমির উপর মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। 

পূর্বে মসজিদের তলদেশের প্রায় ২৫ ফুট গভীরে একটি ইবাদতের ঘর ছিল। স্থানীয়দের মাঝে কথিত আছে মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আব্দুল্লাহ মসজিদের তলদেশের সেই ঘরটিতে ইবাদতে মগ্ন থাকতো। অনেকে বলে থাকেন এই মসজিদটি জ্বীনেরা তাদের ইবাদতের জন্য তৈরী করেছিলো এবং তারা সেখানে বেশ কয়েক বছর ইবাদত করেছিল। গভীর রাতে সেই এলাকার অধিবাসীরা এই মসজিদ থেকে জ্বীনদের জিকিরের আওয়াজ শুনতে পেতেন। 

প্রায় ১৩৫ বছর পরও সেই মসজিদটি এখনো জ্বীনের মসজিদ হিসেবেই পরিচিত। সত্যিই কি এই মসজিদটি জ্বীনেরা তৈরি করেছিল, তা আজও রহস্য হয়েই রয়ে গেছে।

চিকন কালা (Chikon Kala)

চিকনকালা বা নেফিউ পাড়া বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বাংলাদেশ-বার্মা নো ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থিত। চিকনকালা এলাকার স্থানীয় একটি গ্রাম হলো মুরং। সেই এলাকাতে ময়ূর, বাঘ, ভাল্লুক ইত্যাদি বন্যপ্রাণীর আওয়াজ শোনা যায়। চিকন কালা এলাকার স্থানীয়দের মতে প্রতিবছর এক অজানা সময় (দিনটা নির্দিষ্ট নয়) হঠাত কোন জানান না দিয়ে বনের ভিতর থেকে রহস্যময় অদ্ভুত আওয়াজ বেরিয়ে আসে। 

বছরের অনির্দিষ্ট সেই সময়ে শিকারীরা বনে স্বীকার করতে গেলে এবং হঠাৎ আওয়াজ পেলে দৌড়ে বন থেকে পালিয়ে আসতে চায়। কিন্তু প্রতিবারই কয়েকজন পিছিয়ে পড়ে। যারা পিছিয়ে পড়ে, কয়েকদিন পর তাদের মৃতদেহ পাওয়া যায়। কিন্তু তাদের শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন থাকে না। শুধু চেহারায় থাকে ভয়ংকর আতঙ্কের ছাপ।

সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড (Swatch of No Ground)

সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত একটি সংরক্ষিত এলাকা। এটি বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকার দুবলার চর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বাংলাদেশের রহস্যময় ও ভয়ংকর স্থানসমূহের একটি। 

সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড এলাকাটি প্রায় ১৪ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। ১৮৬৩ সালে মেঘনা নদীর সাথে বঙ্গোপসাগরের মিলিত স্থানের মোহনায় দু-মুখী স্রোতের প্রভাবে গ্যাড ফ্লাই নামে ব্রিটিশদের একটি ২১২ টন ওজন বিশিষ্ট গানবোট তলিয়ে গিয়েছিল। সেই গান বোটের মাধ্যমে ভারত থেকে ইংল্যান্ডে বিপুল পরিমাণ ধনরত্ন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। অনেক অনুসন্ধানের পরেও সেই বোটটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

গভীরতম এই উপত্যকার রেকর্ডকৃত গড় গভীরতা প্রায় ১২০০ মিটার। এখানকার ডুবো গিরিখাত বঙ্গীয় উপবদ্বীপের অংশ, যা বিশ্বের বৃহত্তম ডুবো গিরিখাত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ভয়ংকর সেই সামুদ্রিক খাদের উপর নৌভ্রমণে যাওয়ার কথা মনে পড়লেই যেন গাঁ শিরশিরিয়ে ওঠে।

গানস অফ বরিশাল (Guns of Barisal)

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পূর্ববঙ্গের অন্যতম একটি রহস্যময় স্থান হচ্ছে গানস অফ বরিশাল। প্রাচীনকালে ব্রিটিশরা যখন বাংলাদেশের বরিশাল অঞ্চল এসেছিল তখন তার নাম ছিল বাকেরগঞ্জ এলাকা। তখন বাকেরগঞ্জ এলাকাতে থাকা অবস্থায় এক ব্রিটিশ সিভিল সার্জন প্রথমবারের মতো গভীর সাগরের দিক থেকে একসাথে অনেকগুলো কামান ছোড়া গুলির শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। 

বরিশালের সেই অঞ্চলটির মতো তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের দেশগুলোতে এমন কামানের বিকট শব্দ শুনতে পেতেন। ১৮৮৬ সালে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির গবেষণা অনুসারে বরিশাল সহ ভারতবর্ষের অন্যান্য জেলা, যেমন- নোয়াখালী, হরিশপুর, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ ইত্যাদি এলাকাতেও বরিশাল গানস এর মতো ভয়ংকর শব্দ শোনা যেত। প্রায় ১৫০ বছর পরেও সেই ভয়ংকর, তীব্র শব্দের রহস্য আজও উদঘাটন করা যায়নি।

খুলনার ভুতের বাড়ী (Khulna haunted house)

খুলনার ভুতের বাড়ী, বাংলাদেশের খুলনার বাহাদুর লেন -এ অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। কথিত আছে যে রাজা দয়ারামের এক ভাগ্নী, রাজার তহশীলদার অমূল্য ধনের ছেলের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে তারা পালিয়ে বিয়ে করতে চাইলে, ধরা পড়ে যায় এবং শীলা রানীকে নীধুরাম নামের অন্য এক ছেলের সাথে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়। 

আরও পড়ুন: বিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় ৮টি স্থান

তাদের বিবাহিত জীবন যাপনের জন্য দেওয়া হয়েছিল একটি পরিত্যাক্ত বাড়ি। তাদের বৈবাহিক জীবনে কলহ থাকায় এক রাতে শীলা রানী আত্মহত্যা করে এবং তার লাশ দেখে তার স্বামীও আত্মহত্যা করে। রাজার কাছে এই খবর পৌঁছানোর পর বাড়িটিকে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু স্থানীয়দের মাঝে কথিত আছে সেদিন থেকে সেই বাড়িটিতে নারী কণ্ঠের খিলখিল হাসির শব্দ শুনতে পেতেন অনেকেই।

বর্তমানে বাড়ীটি একটি আনসার ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হলেও, কবরস্থানের পাশে হওয়ায় স্থানীয়দের মনে আজও সেই রহস্যময় ভয় কাজ করে।

শেষকথা 

উপরোক্ত আলোচনার বাংলাদেশের রহস্যময় ও ভয়ংকর স্থানসমূহ ছাড়াও দেশের প্রতিটি এলাকায় কম-বেশি রাজাদের আমলের স্থাপনা রয়েছে। এগুলো নির্মানের পেছনেও নানারকম ইতিহাস লুকিয়ে থাকে। 

Scroll to Top