পেট ফাঁপা ও বদহজম থেকে মুক্তির উপায়

আমাদের দৈনন্দিন স্বাস্থ্যভিত্তিক সমস্যা গুলোর মধ্যে পেট ফাঁপা ও বদহজমের সাথে সকলেই কমবেশি পরিচিত। সঠিক খাদ্যাভ্যাস না মানলে কিংবা অন্য কোন কারণেও যেকোনো সময় এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। পেট ফাঁপা ও বদহজম আমাদেরকে অসহ্যকর যন্ত্রণার এবং পেট ব্যথার সম্মুখীন করে। মাঝে মাঝে ঔষধ সেবন করেও এর থেকে মুক্তি মেলেনা। তাই ঘরোয়া ও প্রাকৃতিকভাবে, কম খরচে পেট ফাঁপা ও বদহজম থেকে মুক্তির উপায়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো এই লেখাতে।

বদহজম ও পেট ফাঁপার কারণ

বিভিন্ন কারণে পেট ফাঁপা ও বদহজমের সমস্যা হতে পারে। সাধারণত কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার বেশি খাওয়া হলে এবং হজমে সমস্যা হলে পেটে গ্যাসের সৃষ্টি হয়। এর কারণেই পেট ফেঁপে থাকে। যেসকল কারণে অধিকাংশ ভুক্তভোগী এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়, সেগুলো হলো:

  • কোষ্ঠকাঠিন্য;
  • সিলিয়াক ডিজিজ;
  • ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম;
  • খাওয়ার সময়ে কথা বলার মাধ্যমে বাতাস গিলে ফেলা;
  • প্রতিটি ব্যক্তির পাকস্থলীর কার্যক্ষমতা নির্দিষ্ট। তাই কেউ যদি এমন খাবার খায় যা তার পেটের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, সেক্ষেত্রে পেট ফাঁপার সমস্যা হয়;
  • পায়ুপথ দিয়ে অতিরিক্ত বায়ু ত্যাগ করা।

এসকল কারণে পেটের যাবতীয় সমস্যা তীব্রতার হয়।

পেট ফাঁপা ও বদহজম থেকে মুক্তির উপায়

পেট ফাঁপা ও বদহজম জনিত সমস্যায় আমরা যেকোনো সময়ই পড়তে পারি। তাই তাৎক্ষণিকভাবে এর থেকে মুক্তি পেতে অথবা দীর্ঘমেয়াদি পেটের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে কিছু ঘরোয়া উপায় অনুসরণ করা যায়। নিচে সবচেয়ে কার্যকরী উপায়গুলো তুলে ধরা হলো:

বদহজম থেকে মুক্তির উপায়

তুলসী পাতা

পেটের সমস্যা দূর করতে প্রাচীনকাল থেকে তুলসী পাতার ব্যবহার হয়ে আসছে। তুলসীতে এমন পদার্থ রয়েছে, যা গ্যাসের সমস্যা কমায় ক্ষুধা বাড়ায়, পেটে ব্যথা, অস্বস্তি, ফোলাভাব কমায় এবং সামগ্রিক হজমে উন্নতি করে। এতে ইউজেনল নামক উপাদানও থাকে, যা পেটে অ্যাসিডের পরিমাণ হ্রাস করে। তাই তাৎক্ষণিক সমাধান পেতে তুলসী পাতার নির্যাস খেতে পারেন, অথবা চায়ের সাথে মিশিয়ে পান করতে পারেন।

জিরা পানি খাওয়া 

জিরা আমাদের পাকস্থলীর এসিডকে নিয়ন্ত্রণ করে পেটের ব্যথা দূর করতে এবং হজমক্রিয়া উন্নত করতে সহায়তা করে। তাৎক্ষণিকভাবে পেটের গ্যাস নিয়ন্ত্রণের জন্য, ১ গ্লাস পানিতে সামান্য জিরার গুঁড়ো মিশিয়ে বা ফুটিয়ে ছেঁকে নিন। এবার প্রতিবেলা খাবারের পর এই মিশ্রণটি খেতে পারেন। একইভাবে, ১ গ্লাস পানিতে আধা চামচ দারুচিনির গুঁড়ো বা আস্ত দারুচিনি ফুটিয়ে নিয়ে, দিনে ২-৩ বার খেতে পারেন।

আদা খাওয়া

হজমের সমস্যা দূর করার জন্য দ্রুততম ঘরোয়া টোটকাটি হলো আদা খাওয়া। আদা আমাদের হজমকার্যকে দ্রুততম করে এবং পেট ফাঁপার সমস্যা দূর করে। যাদের সবসময়ই পেটে নানা রকম সমস্যা চলতে থাকে তাদের জন্য এটি সেবন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন খাবার পর ১ টুকরো আদা চিবিয়ে খেলে পেট ফাঁপার সমস্যা হবেনা। এছাড়াও আদা কুঁচি করে সামান্য লবণ মাখিয়ে খেলে অথবা আদা ছেঁচে লবণ দিয়ে আদার রস পান করে নিতে পারেন। আদা চা পান করাও ভালো ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

বেকিং সোডা ও লেবুর রস

অল্প একটু বেকিং সোডা ও লেবুর রস ১ গ্লাস পানিতে মিশিয়ে খেলে বদহজমের সমস্যা থেকে দ্রুত উপশম মেলে। এই মিশ্রণটি আমাদের পাকস্থলীতে কার্বনিক অ্যাসিড উৎপাদন করে। কার্বনিক অ্যাসিড পেটের গ্যাস এবং বদহজম হ্রাস করতে সাহায্য করে। একইসাথে, এটি লিভারের ক্ষরণ এবং অন্ত্রের গতিশীলতাও উন্নত করে তুলে।

টকদই খাওয়া 

টকদই আমাদের অন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি করার মাধ্যমে ডাইজেস্টিভ ট্র্যাক উন্নত করে এবং হজমশক্তি বৃদ্ধি করে। যাদের পেট ফাঁপার সমস্যা রয়েছে তারা টকদই খেলে দ্রুতই উপশম পাবেন।

পাকা পেঁপে খাওয়া

পেঁপে ফলে আমাদের খাদ্যান্ত্রের জন্য উপকারী পাপায়া নামক এনজাইম থাকে। এটি হজমশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক। সম্ভব হলে নিয়মিত পেঁপে খেতে পারলে দীর্ঘদিনের বদহজম জনিত সমস্যা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।

কাঁচা হলুদ খাওয়া 

কাঁচা হলুদ পেটের নানারকম সমস্যার প্রাকৃতিক সমাধান। কাঁচা হলুদ চিবিয়ে খেলে দ্রুত পেট ফাঁপার সমস্যার সমাধান হয়। আপনি যদি সরাসরি কাঁচা হলুদ না খেতে পারেন, তাহলে আদার মতো হলুদ ছেঁচে নিয়ে পানির সাথে মিশিয়ে, চা তৈরি করে পান করতে পারেন।

ডাবের পানি পান 

ডাবের পানি রিহাইড্রেটিংয়ের জন্য বেশ কার্যকর এবং বেশিরভাগ স্পোর্টসম্যানরা ড্রিঙ্কের চেয়ে এটি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। এই পানিতে উচ্চ মাত্রায় পটাশিয়াম এবং ম্যাগনেশিয়াম থাকে। এতে ক্যালোরি ও চিনির পরিমাণ কম থাকায় অন্যান্য স্বাস্থ্য ঝুঁকিরও সম্ভাবনা নেই। অতিরিক্ত সমস্যা দেখা দিলে, প্রতি ৪-৬ ঘণ্টা পরপর ২ গ্লাস করে ডাবের পানি পান করুন। এতে পেট ফাঁপার সমস্যার সমাধান হবে।

কলা খাওয়া 

বদহজম দূর করতে কলাও অত্যন্ত কার্যকর একটি উপাদান। এতে থাকে ভিটামিন বি-৬, পটাসিয়াম, এবং ফোলেট। এটি বদহজমের ফলে হওয়া কোষ্ঠকাঠিন্য ও ডায়রিয়া উপশম করে। একইসাথে, পেটের ব্যথাও কমায়। তাই বেশ কয়েকদিন যাবত এই সমস্যায় ভুগে থাকলে নিয়মিত কলা খেতে পারেন। তবে খেয়াল রাখবেন, মাত্রাতিরিক্ত কলা খেলে গ্যাস্ট্রিকজনিত সমস্যা হতে পারে।

উপরোক্ত খাদ্য উপাদানগুলো সেবন করার পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে কিছু বিষয় মেনে চলতে হবে। তাহলে যাবতীয় সমস্যা থেকে দ্রুত উপশম পাবেন।

বদহজম ও পেট ফাঁপার সমস্যায় যা যা করতে হবে

  • পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন। এই পানি আমাদের খাবার হজম করার প্রক্রিয়াকে গতিময় করে দেবে। বিশেষ করে, যেসকল মানুষ খাবার হজমজনিত সমস্যায় ভুগে, তাদের অধিক পরিমাণে পানি পান করা উচিত।
  • পেটে ফোলাভাব ও অস্বস্তি হলে কয়েক ঘণ্টা বসে, দাঁড়িয়ে বা হাঁটাহাঁটির মধ্যে থাকুন। এসময় শুয়ে থাকবেন না। শুয়ে থাকলে পেটের অস্বস্তি আরও বাড়বে।
  • শসা বা এ ধরনের পানিজাতীয় ফলবা সবজি খেতে পারেন। এতে পেট ঠান্ডা থাকবে এবং শসার ফ্লেভোনয়েড ও অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান পেটে গ্যাসের সমস্যা কমাবে।
  • হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করুন। এতে কিছুটা স্বস্তি মিলবে। পাশাপাশি হিটিং ব্যাগের সাহায্যে পেটে ১৫-২০ মিনিটের জন্য তাপ প্রয়োগ করতে পারেন।
  • কার্বোনেটেড কোমল পানীয় খাওয়া যাবেনা।
  • নিয়মিত ব্যায়াম করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

বদহজম হলে কি খাওয়া উচিত | পেট ফাঁপা দূর করার ঘরোয়া উপায়

দীর্ঘদিন একটানা বদহজম কিংবা পেট ফাঁপা জনিত সমস্যায় ভুগলে নিজেদের খাদ্যাভাসে পরিবর্তন করা বাঞ্ছনীয়। ভুক্তভোগীদের খাদ্য তালিকায় নিম্নোক্ত খাদ্যগুলো রাখলে উপকার পেতে পারেন:

  • প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। যেমন- দই, কেফির, কিমচির (গাঁজন করা সবজি) ইত্যাদি খাবারগুলো। এগুলো আমাদের বৃহদন্ত্রের জন্য উপকারী ব্যাকটেরিয়া গুলোর পরিমাণ এবং হজমশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।
  • হোল গ্রেন/ খোসাযুক্ত শস্য/ গোটা শস্য খেলে দ্রুত পেট ভর্তি হওয়ার অনুভূতি তৈরি হয়। ফলে অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার চাহিদা কমে যায়। হোল গ্রেনে ভিটামিন ই, জিঙ্ক ও নিয়াসিনের মতো উপাদানঅও থাকে। যা একইসাথে ক্যানসার ও হৃদযন্ত্রের সমস্যার আশঙ্কা কমায়।
  • রঙিন ফলমূল পর্যাপ্ত পরিমাণে খাওয়া। খাবার গ্রহণের এক ঘণ্টা পর রঙিন ফল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুললে, খাবার দ্রুত হজম হবে।

এছাড়াও হজমশক্তি বাড়াতে দারুচিনি, পুদিনাপাতার রস, আদা ইত্যাদি খাদ্য উপাদানগুলো খেতে পারেন। এগুলোতে থাকা প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস গুনাগুন পেটের সমস্যা সমাধান করে। একইসাথে, উপরোক্ত পেট ফাঁপা ও বদহজম থেকে মুক্তির উপায়গুলো থেকে আপনার জন্য উপযুক্ত উপায়টি দৈনন্দিন খাদ্যাভাসে প্রয়োগ করতে পারেন।

শিশুর পেট ফাঁপা হলে করণীয়

সাধারণত ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে পেট ফাঁপার সমস্যা দেখা দেয় মাতৃদুগ্ধ খাওয়ানোর ত্রুটির কারণে। মাঝে মাঝে ফিডারে করে দুধ খেতে গিয়ে কিংবা ঢোক গিলার সময় শিশুর পেটে বাতাস ঢুকেও গ্যাস হয়। নবজাতক শিশুর পেটের গ্যাস বা বাতাস দুধ খাওয়ার পরপরই বের করে দিতে হবে। দুধ খাওয়ানোর পর মায়ের ঘাড়ের বাঁ পাশে বা ডান পাশে নিয়ে শিশুর পিঠের ওপর থেকে নিচের দিকে হাত বুলিয়ে দিন। এতে গ্যাস বা বাতাস বের হয়ে যায়।

আরো পড়ুন: শীতকালে ঠোঁট গোলাপি করার উপায়

ছয় মাসের বেশি বয়সী শিশুদেরকে মাতৃদুগ্ধ ছাড়া বাড়তি খাবার দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে শিশুর পেটের জন্য উপযুক্ত খাবার বাছাই করতে হবে। পাশাপাশি ফলমূল নরম টুকরো বা জুস খাওয়াতে পারেন। এতে হজমের সুবিধা হবে ও শিশুর পেটে গ্যাস তৈরির প্রবণতা অনেকটাই কমে যাবে। তবে যদি শিশুর পেট ফাঁপা না কমে, অতিরিক্ত কান্না করে, পেট শক্ত হয়ে যায় এবং বমি হয়, গায়ে জ্বর অনুভূত হয়, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। 

কখন ডাক্তারের কাছে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ

সাধারণত সবসময় কিংবা দীর্ঘদিন যাবত পেট ফাঁপার সমস্যা হলে সেটি কোনো মারাত্মক রোগ, এমনকি ক্যান্সারের লক্ষণও বহন করতে পারে। নারীদের ক্ষেত্রেও পেট ফাঁপা এবং সবসময় পেট ভরা মনে হওয়া ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান লক্ষণ। এক্ষেত্রে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। পেট ফাঁপার সমস্যায় সাধারণত এ ধরনের লক্ষণ দেখা গেলেও, দীর্ঘদিনের সমস্যায় বড় ক্ষতির আভাস থাকতেই পারে। তাই বিষয়টি হালকাভাবে না নিয়ে, গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

শেষকথা 

উপরোক্ত পেট ফাঁপা ও বদহজম থেকে মুক্তির উপায়গুলো মেনে এ ধরনের অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে পারেন। তবে পেট ফাঁপা ও বদহজমের লক্ষণ স্পষ্ট না হলে আপনার পেট ব্যথার বা অস্বস্থির কারণ খুঁজে বের করুন। রোগের সুনির্দিষ্ট কারণ না জেনে ঔষধ সেবন করা মোটেই ঠিক নয়। 

Scroll to Top