নেটওয়ার্ক টপোলজি কি? এর প্রকারভেদ এবং ব্যবহার

নেটওয়ার্ক টপোলজি (Network Topology) হলো কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সংগঠন প্রক্রিয়া। নেটওয়ার্ক টপোলজি কি, এর প্রকারভেদ, ব্যবহার ও কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারবেন এই আলোচনায়।

কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সাথে বিভিন্ন ফিজিক্যাল ডিভাইস গুলোকে সংযুক্ত রাখতে নেটওয়ার্ক টপােলজি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে ইন্টারনেট ভিত্তিক কার্যক্রমে এবং আমাদের পাঠ্যক্রমেও এই টপোলজি একটি অতি পরিচিত বিষয়। তাই নেটওয়ার্ক টপোলজি কি এবং সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য এই আর্টিকেলে তুলে ধরা হলো।

নেটওয়ার্ক টপোলজি কি?

একটি নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত কম্পিউটার সমূহ এবং আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি গুলো একে অপরের সাথে সংযুক্ত থাকার পদ্ধতিই হলো নেটওয়ার্ক টপোলজি৷

সাধারণত নেটওয়ার্ক সিস্টেমের ফিজিক্যাল ডিভাইস বা কম্পনেন্ট, যেমন- কম্পিউটার, রাউটার, প্রিন্টার, কেবল ইত্যাদি যেভাবে একটি নেটওয়ার্কে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত থাকে, তাকে নেটওয়ার্ক টপোলজি বলা হয়।

কয়েকটি কম্পিউটার শুধুমাত্র তার দিয়ে জোড়া দিয়েই বিক্ষিপ্তভাবে নেটওয়ার্ক তৈরি করা যায় না। বরং লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত কম্পিউটার ও অন্যান্য যন্ত্রগুলোর ভৌত সংযোগ বিন্যাস এবং সহজে ডাটা আদান-প্রদানের সুনিয়ন্ত্রিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা গুরুত্বপূর্ণ। নেটওয়ার্ক টপোলজি সেই লেআউট প্রস্তুত করে থাকে। এ ধরনের নেটওয়ার্কে সংযুক্ত প্রতিটি যন্ত্রের সংযোগস্থলকে নোড নামে অভিহিত করা হয়৷

নেটওয়ার্ক টপােলজি কত প্রকার ও কি কি?

বর্তমান সময় অব্দি, পৃথিবী জুড়ে কম্পিউটার নেটওয়ার্কিং এর জন্য মূলত ছয় ধরনের নেটওয়ার্ক টপোলজি ব্যবহার করা হয়। যথাঃ

  • বাস টপোলজি (Bus Topology)
  • ট্রি টপোলজি (Tree Topology)
  • রিং টপোলজি (Ring Topology)
  • স্টার টপোলজি (Star Topology)
  • হাইব্রিড টপোলজি (Hybrid Topology)
  • মেশ টপোলজি (Mesh Topology)

এছাড়াও লাইন টপোলজি (Line Topology) নামে আরেকটি নেটওয়ার্কিং সিস্টেমের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

সকল প্রকার নেটওয়ার্ক টপোলজি সম্পর্কে বিস্তারিত ধারনা

বর্তমানে যেসকল টপোলজি ব্যবহৃত হয়, সেই নেটওয়ার্ক টপোলজি কিভাবে কাজ করে, সেগুলোর প্রাথমিক ধারণা ও সুবিধা-অসুবিধা নিচে তুলে ধরা হলোঃ

বাস টপোলজি (Bus Topology Network)

যে টপোলজিতে নেটওয়ার্ক স্থাপনের জন্য, একটি মূল তারের সাথে সকল কম্পিউটার বা ওয়ার্কস্টেশন সংযুক্ত থাকে তাকে বাস টপোলজি বলে।

বাস টপোলজির প্রধান ক্যাবলটিকে ব্যাকবোন (Backbone) বলা হয়। যখন কোন নেটওয়ার্ক সিগন্যাল এই ব্যাকবোনে চলাফেরা করে তখন শুধু প্রাপক কম্পিউটারটি সিগন্যাল গ্রহণ করতে পারে। বাকিরা এই সিগন্যাল কে অগ্রাহ্য করবে। বাস টপোলজিতে একই নেটওয়ার্কের ভিন্ন ক্যাবলও ব্যবহার করা যায়। এই নেটওয়ার্ক টপোলজি কিছু ছোট আকারের নেটওয়ার্কে ব্যবহার করা হয়। নেটওয়ার্কের কোন একটি কম্পিউটার নষ্ট হয়ে গেলে সম্পূর্ণ সিস্টেম নষ্ট হয়ে যায়না।

বাস টপোলজির সুবিধা

  • ছোট আকারের নেটওয়ার্কে ব্যবহারের জন্য খুবই সহজ, নিরাপদ এবং সাশ্রয়ী।
  • কোন একটি কম্পিউটার নষ্ট হয়ে গেলে সম্পূর্ণ সিস্টেম বাতিল হয়ে যায় না।
  • রিপিটার ব্যবহার করে নেটওয়ার্কের ব্যাকবোন প্রসারিত করা যায়।
  • এই টপোলজিতে কেবল কম প্রয়োজন হয়। ফলে খরচও কম হয়।
  • নেটওয়ার্কে নতুন কোন কম্পিউটার বা ওর্য়াকস্টেশন যোগ করলে বা সরিয়ে নিলে নেটওয়ার্কের কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।

বাস টপোলজির অসুবিধা

  • নেটওয়ার্কে কম্পিউটারের সংখ্যা বেশি হলে ডাটা স্থানান্তর বিঘ্নিত হয়।
  • ডাটা স্থানান্তরের গতি কম।
  • নেটওয়ার্কে কোন সমস্যা দেখা দিলে তা নির্ণয় করা কঠিন হয়।
  • মূল ক্যাবল বা ব্যাকবোনের সামান্য ত্রুটি সম্পূর্ণ নেটওয়ার্ক অকেজো করতে পারে।

রিং টপোলজি (Ring Topology Network)

এই নেটওয়ার্কিং সিস্টেমে প্রতিটি কম্পিউটার তার পার্শ্ববর্তী কম্পিউটারের সাথে সংযুক্ত থাকে। রিং পদ্ধতিতে নেটওয়ার্কের সর্বশেষ কম্পিউটারটি পুনরায় প্রথম কম্পিউটারের সাথে সংযুক্ত হয়। নেটওয়ার্কের কোন কম্পিউটার ডাটা প্রেরণ করলে, প্রাপক কম্পিউটার ডাটা গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত তা বৃত্তাকার পথে ঘুরতে থাকে। এই পদ্ধতিতে কোন কেন্দ্রীয় কম্পিউটার নেই বরং সকল কম্পিউটারের গুরুত্ব সমান।

রিং টপোলজির সুবিধা

  • সার্ভার কম্পিউটারের প্রয়োজন হয় না।
  • ডাটা প্রবাহ একমুখী হওয়ায় Data Commission বা সংঘর্ষ হয় না।
  • ক্যাবল কম লাগে।
  • নেটওয়ার্কে সংযুক্ত প্রতিটি কম্পিউটারের গুরুত্ব সমান।

রিং টপোলজির অসুবিধা

  • কোন একটি কম্পিউটার নষ্ট হয়ে গেলে সম্পূর্ণ সিস্টেম অচল হয়ে পড়ে।
  • নেটওয়ার্কে নতুন কোন কম্পিউটার যোগ করলে বা সরিয়ে নিলে সম্পূর্ণ নেটওয়ার্কের কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  • নেটওয়ার্কে সমস্যা দেখা দিলে তা নিরূপণ করা জটিল।

স্টার টপোলজি (Star Topology Network)

এই টপোলজিতে একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকারী কম্পিউটারের সাথে অন্যান্য কম্পিউটার সংযুক্ত করে নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হয়। স্টার নেটওয়ার্ক টপোলজি কিছু তথ্য আদান-প্রদান করতে প্রথমে কেন্দ্রীয় কম্পিউটারে প্রেরণ করা হয় সাহায্য নেয়। তারপর তা প্রাপক কম্পিউটারে পাঠানো হয়।

কোন একটি কম্পিউটার নষ্ট হলে, তা নেটওয়ার্কের উপর প্রভাব ফেলে না এবং সেটি খুব সহজেই সরিয়ে ফেলা যায়। এই টপোলজিতে বিভিন্ন ধরনের ক্যাবল ব্যবহার করা যায়।

স্টার টপোলজির সুবিধা

  • কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা থাকায় নেটওয়ার্কের সমস্যা নিরূপণ সহজ হয়।
  • নেটওয়ার্কে খুব সহজে নতুন কম্পিউটার যুক্ত করা যায় এবং ক্ষতিগ্রস্ত কম্পিউটার সরিয়ে নেওয়া যায়।
  • Intelligent Hub ব্যবহার করলে, তার মাধ্যমে নেটওয়ার্কের ওয়ার্কলোড মনিটরিং করা য়ায়।
  • একটি কম্পিউটার নষ্ট হলে নেটওয়ার্কিং সিস্টেমে বা অন্য কম্পিউটারে কোন প্রভাব পড়ে না।
  • বিভিন্ন ধরনের ক্যাবল ব্যবহার করা যায়।

স্টার টপোলজির অসুবিধা

  • কেন্দ্রীয় Hub -এ কোন সমস্যা হলে সম্পূর্ণ নেটওয়ার্ক অকেজো হয়ে পড়ে।
  • বেশি ক্যাবল ব্যবহৃত হয়, তাই তুলনামূলক ব্যয়বহুল।
  • কম্পিউটারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে ডাটা স্থানান্তরের গতি হ্রাস পায়।

ট্রি টপোলজি (Tree Topology Network)

এই নেটওয়ার্ক টপোলজি কিছু কম্পিউটারকে পরস্পরের সাথে গাছের শাখা প্রশাখার মতো বিন্যস্ত করে তৈরি বলে, এটিকে ট্রি টপোলজি বলে। এই পদ্ধতিতে এক বা একাধিক স্তরের কম্পিউটার গুলো সার্ভার কম্পিউটারের সাথে সংযুক্ত থাকে।

এই নেটওয়ার্কিং সিস্টেমে প্রথম স্তরের কম্পিউটারগুলো দ্বিতীয় স্তরের কম্পিউটারের হোস্ট/ সার্ভার হয়। একইভাবে, দ্বিতীয় স্তরের কম্পিউটারগুলো তৃতীয় স্তরের কম্পিউটারের হোস্ট/ সার্ভার হয়। শাখা-প্রশাখা ভিত্তিক মাধ্যমে এই নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করা সহজ। অফিস ব্যবস্থাপনায় এটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়।

ট্রি টপোলজির সুবিধা

  • অফিস ব্যবস্থাপনার জন্য অত্যন্ত উপযোগী।
  • নতুন শাখা প্রশাখা তৈরীর মাধ্যমে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করা যায়।
  • নতুন কোন কম্পিউটারের সাথে নোড সংযুক্ত করলে বা বাদ দিলে সম্পূর্ণ নেটওয়ার্কের কোন সমস্যা হয়না।

ট্রি টপোলজির অসুবিধা

  • ট্রি টপোলজির বাস্তবায়ন কিছুটা জটিল।
  • ক্যাবল বেশি লাগে, তা তুলনামূলক ব্যয়বহুল।
  • সার্ভার কম্পিউটারে সমস্যা হলে সমগ্র নেটওয়ার্কটি অচল হয়ে যায়।

হাইব্রিড টপোলজি (Hybrid Topology Network)

কয়েকটি নেটওয়ার্ক টপোলজি নিয়ে হাইব্রিড টোপোলজি গঠিত হয়। এটি একটি বৃহৎ নেটওয়ার্কিং সিস্টেম, যা বাস, স্টার, রিং ইত্যাদি টপোলজি নিয়ে গঠিত। সকল প্রকার টপোলজি নিয়ে গঠিত হওয়ায়, সমগ্র ইন্টারনেট বা বৈশ্বিকজালকে এ ধরনের টপোলজি বলা যায়।

প্রয়োজনানুসারে এই নেটওয়ার্ক টপোলজি কিছু নতুন কম্পিউটার যুক্ত করতে সহজসাধ্য। এবং সহজেই কোন একটি অংশ নষ্ট হলে তার নেটওয়ার্ক থেকে সরিয়ে ফেলা যায়।

হাইব্রিড টপোলজির সুবিধা

  • ডাটা স্থানান্তরের জন্য একাধিক পথ প্রদান করে।
  • নেটওয়ার্ক ডিজাইন এবং লেআউটের ক্ষেত্র সহজেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য।
  • একটি হাইব্রিড টোপলোজি ব্যবহারের মাধ্যমে বাস, রিং, স্টার ইত্যাদি টোপোলজির সামগ্রিক খরচ একত্রে করে কমিয়ে আনা যায়।
  • নতুন সংযোগ যুক্ত এবং ত্রুটিযুক্ত সংযোগ সরিয়ে ফেলা যায়।
  • একটি সংযোগ নষ্ট হলে সমগ্র নেটওয়ার্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।

হাইব্রিড টপোলজিরং সুবিধা

  • পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রক্রিয়া তুলনামূলকভাবে জটিল।
  • নেটওয়ার্কের কোন স্থানে সমস্যা হলে তা নিরূপণ করা জটিল।
  • ডাটা স্থানান্তরের গতি তুলনামূলক কম হয়।

মেশ টপোলজি (Mesh Topology Network)

একটি নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত কোন ডিভাইস বা কম্পিউটার গুলোর মধ্যে অতিরিক্ত সংযোগ থাকলে, তাকে মেশ টোপোলজি বলা হয়। এতে অতিরিক্ত লিংক দেওয়া থাকে তাই ডাটা কানেকশনের অনেক বেশি নিশ্চয়তা থাকে।

মেশ টপোলজিতে প্রতিটি কম্পিউটারের সাথে নেটওয়ার্কের সকল কম্পিউটারই সংযুক্ত থাকে এবং প্রথম কম্পিউটারের সাথে শেষ কম্পিউটারটিও সংযুক্ত থাকে। রিং নেটওয়ার্ক টপোলজি কিছু কম্পিউটারকে একে অপরের সাথে অতিরিক্ত নোড দিয়ে সংযুক্ত করলেই মেশ টপোলজিতে তৈরি হবে।

মেশ টপোলজির সুবিধা

  • ডাটা স্থানান্তরের গতি বেশি হয়।
  • ডাটা কমিউনিকেশনের নিশ্চয়তা অনেক বেশি।
  • একটি কম্পিউটার নষ্ট হলে নেটওয়ার্কিং সিস্টেমের ক্ষতি হয় না।

মেশ টপোলজির অসুবিধা

  • নেটওয়ার্ক স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা তুলনামূলক জটিল।
  • অতিরিক্ত নোড এবং তার স্থাপন করতে হয় বলে এটি ব্যয়বহুল।
  • কোন টপোলজি সুবিধাজনক
  • কম্পিউটার নেটওয়ার্ক স্থাপনের জন্য কোন টপোলজি সবচেয়ে বেশি সুবিধাজনক, তা নির্ভর করে- নেটওয়ার্কের পরিধি, কম্পিউটার সংখ্যা, ব্যবস্থাপনা, বাজেট ইত্যাদি বিষয়ের উপর।

সাধারণত স্টার টপোলজি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। এই পদ্ধতিতে প্রতিটি কম্পিউটার একটি কেন্দ্রীয় হাব, সুইচ বা কম্পিউটারের সাথে সংযুক্ত থাকে। এটি ব্যবহারকারী-বান্ধব, নিরাপদ এবং পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা তুলনামূলক সহজ।

আরো পড়ুন: ন্যানো টেকনোলজি কি?

শেষকথা

উপরোক্ত আলোচনা থেকে নেটওয়ার্ক টপোলজি কি তা জানতে পারলেন। এসকল টপোলজিরং সুবিধা ও অসুবিধা পর্যালোচনা করে আপনাদের জন্য উপযুক্ত নেটওয়ার্কিং সিস্টেমটি বেছে নিতে পারেন।

Scroll to Top