মহাকাশ একটি সুবিশাল ও রহস্যময় স্থান। পৃথিবীবাসীর জন্য মহাকাশ একটি ধ্রুবক আবিষ্কার এবং বিস্ময়ের রাজ্য। মানুষ নয়, পৃথিবীও নয় বরং সমগ্র সৌরজগতই মহাকাশে একটি বালুকনা থেকেও ছোট বলে গন্য হয়।
আজকের আলোচনায় মহাকাশ সম্পর্কে ১৫টি অবিশ্বাস্য তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, যা রীতিমতো অবাক হবেন আপনিও। চলুন জেনে নেই, মহাকাশ সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের সেই অবিশ্বাস্য আবিষ্কারের তথ্য সমূহ।
(১) এক চা-চামচ নিউট্রন তারার ওজন পৃথিবীর সমস্ত মানুষের ওজনের সমান
সাধারণভাবে একটি নিউট্রন নক্ষত্রের ঘনত্ব অনেক বেশি হয়। এই নক্ষত্রগুলো একটি ক্ষুদ্র ব্যাসার্ধে একত্রিত হয়ে প্রায় সম্পূর্ণ নিউট্রন দ্বারাই গঠিত হয়। এই নিউট্রন তারার মাত্র এক চা-চামচ পরিমাণ উপাদানের ওজন হবে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন কিলোগ্রাম।
পৃথিবীর সমগ্র মানব জনসংখ্যার ওজন বর্তমানে প্রায় কয়েক শত বিলিয়ন কিলোগ্রামে পৌঁছে গেছে। তবে এর থেকেও অনেক বেশি নিউট্রন তারার ১ চা-চামচ আকৃতির ওজন। নিউট্রন নক্ষত্রের মতো ঘন ও ভারি কোন উপাদান তৈরি করতে চাইলে, সমগ্র মানবজাতিকে একটি ‘সুগার কিউব’ আকৃতির স্থানে আবদ্ধ করতে হবে।
(২) গামা-রশ্মি বিস্ফোরণের অবিশ্বাস্য শক্তি
গামা-রশ্মি বিস্ফোরণ হলে ১০ সেকেন্ড যেই শক্তি নির্গত করে, তা আমাদের সৌরজগতের সূর্যের সারাজীবনে নির্গত শক্তির থেকেও বেশি। মহাবিশ্বের কোন কিছুই গামা-রশ্মি বিস্ফোরণের সময় উন্মোচিত শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে পারে না। এটি অবিশ্বাস্যভাবে অতি তীব্র এবং উচ্চ-শক্তির বিকিরণ ছড়ায়।
গামা-রশ্মি এর বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে এবং বিভিন্ন কারণে এটি বিস্ফোরিত হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, একটি বিশাল নক্ষত্র বিস্ফোরিত হলে এটি নির্গত হয়। আবার কখনও কখনও দুটি নিউট্রন তারা একত্রিত হলেও এটি সংঘটিত হয়।
(৩) নেপচুন ও ইউরেনাসের হীরার বৃষ্টি
মহাকাশ সম্পর্কে ১০টি অজানা তথ্যের একটি আশ্চর্যকর তথ্য হলো নেপচুন এবং ইউরেনাসের বায়ুমণ্ডলে হীরার বৃষ্টি হয়। সেখানে তাপমাত্রা এবং চাপ অনেক বেশি থাকায়, তা কার্বন পরমাণুগুলোকে ক্রিস্টালাইজ করে হীরার কনাতে পরিবর্তিত করতে সক্ষম। সেই হীরার কনা গুলো বৃষ্টির মতো গ্রহের কোরের দিকে পড়ে বলে ধারণা করা হয়।
(৪) সূর্যের বায়ুমণ্ডল তার পৃষ্ঠের চেয়েও বেশি উত্তপ্ত
গবেষণা অনুযায়ী, সূর্যের পৃষ্ঠ বা ফটোস্ফিয়ারের তাপমাত্রা প্রায় ৫,৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর বায়ুমণ্ডল করোনা নামে পরিচিত। সূর্যের বায়ুমণ্ডল অবিশ্বাস্যভাবে এর পৃষ্ঠের চেয়েও বহুগুনে উত্তপ্ত। ধারণা করা হয়, সূর্যের বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা প্রায় ১ মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি। এই প্যারাডক্সিক্যাল বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে বৈজ্ঞানিক তদন্তের বিষয় হিসেবে আরো গবেষণা চলছে।
(৫) মহাকাশের নিরবতা
মহাকাশের সর্বত্রই নিরবতায় আচ্ছন্ন। সেখানে কোনপ্রকার শব্দ পাওয়া যায় না। সাধারণত শব্দ একই স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাচলের জন্য বায়ুর এবং অন্যান্য উপাদানের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু মহাকাশ হলো একটি নিখুঁত শূন্যস্থান।

মহাকাশের কোন আবহাওয়া ও বায়ুমণ্ডল না থাকায়, শব্দ তরঙ্গ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাচল করতে পারেনা এবং নক্ষত্রের মধ্যবর্তী অঞ্চলটি সর্বদা নিশ্চুপ থাকে। নভোচারীরাও মহাকাশে তাদের যোগাযোগের জন্য রেডিও তরঙ্গের উপর নির্ভর করে।
(৬) মানুষের তৈরি সবচেয়ে দূরবর্তী বস্তু
পৃথিবীতে মানুষের উৎপাদিত বস্তুর মধ্যে সবচেয়ে দূরবর্তী স্থানে অবস্থান করছে ‘ভয়েজার ১’। পৃথিবী থেকে এটি উৎক্ষেপন করা হয়েছিল প্রায় ৪৬ বছর আগে। ১৯৭৭ সালে NASA দ্বারা এই মহাকাশ যানটি প্রবর্তন করা হয়েছিল।
এটি আন্তঃনাক্ষত্রিক মহাকাশে প্রবেশ করেছে এবং আমাদের সৌরজগতের বাইরের অবস্থা সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য পৃথিবীতে পাঠাচ্ছে। এটি ক্রমান্বয়ে আরো দূরে গিয়ে মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণ করছে। ২০২২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ‘ভয়েজার ১’ পৃথিবী থেকে প্রায় ২৩.৫ বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে ছিল।
(৭) NASA- এর একটি সম্পূর্ণ স্পেস স্যুটের দাম $১২,০০০,০০০।
পূর্বে NASA- এর একটি সম্পূর্ণ স্পেস স্যুটের দাম নির্ধারিত হয়েছিল $১২ মিলিয়ন। বর্তমানে সেগুলোর মূল্য প্রায় $১৫০ মিলিয়ন হবে। ১৯৭৪ সালে তৈরি স্পেস স্যুটগুলো ২০১৯ সালে পর্যন্ত পুনরায় ব্যবহৃত হয়।
(৮) মহাকাশের ধারণাকৃত আকৃতি
মহাকাশে বিশালতা প্রকৃতভাবে অনুধাবন করা যায়নি। তবে গবেষণা অনুযায়ী ধারণা করা হয়, পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের মোট দেশ প্রায় ৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষের বেশি।
অর্থাৎ কোন বস্তু যদি আলোর গতিতে চলাচল করতে পারে, তাহলে সমগ্র পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অতিক্রম করতে প্রায় ৯৩ বিলিয়ন বছর লাগবে। মহাকাশের এই আকৃতি থেকে মহাবিশ্বের গভীরতা কেমন এবং কতটা রহস্যময় তা অনুমান করা যায়।
(৯) চাঁদের আকৃতি লেবুর মতো
রাতের আকাশে আমার যখন চাঁদ দেখতে পাই, তখন পৃথিবীর প্রাকৃতিক আমাদের কাছে প্রায় বৃত্তাকার মনে হয়। তবে প্রকৃতপক্ষে চাঁদের আকৃতি একটি লেবুর মতো। চাঁদের বিষুবরেখার চারপাশে, নিকটবর্তী এবং দূরবর্তী উভয় দিকে চ্যাপ্টা খুঁটি এবং বুলেজ রয়েছে।
ধারণা করা হয়, চাঁদের এই অদ্ভুত আকৃতিটি পৃথিবীর গঠনের পরপরই চাঁদের তার সাথে মিথস্ক্রিয়া চলাকালীন সময়ে তৈরি হয়েছিল।
(১০) ডার্ক ম্যাটারের পরিপূর্ণতা
ডার্ক ম্যাটার হলো মহাকাশের একটি রহস্যময় পদার্থ। মহাবিশ্বের মোট ভর এবং মোট শক্তির প্রায় ২৭% তৈরি এই ডার্ক ম্যাটার দিয়ে। এটি আলো বা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বিকিরণের অন্যান্য রূপের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে না। ফলে এটি অদৃশ্য হয়। মহাকাশে থাকা গ্যালাক্সি এবং অন্যান্য মহাকাশীয় বস্তুতে এর মহাকর্ষীয় প্রভাব পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমেইএই ডার্ক ম্যাটারের উপস্থিতি সনাক্ত করা যায়।
(১১) মহাবিশ্বের সর্বত্রই পানি রয়েছে
মহাকাশের সর্বত্রই পানির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র করার আকৃতিতে ঘোলাটে ভাব ধারণ করে, জলীয় বাষ্প হিসেবে মহাকাশে ছড়িয়ে আছে হাজার হাজার মেট্রিক টন পানি। পৃথিবীর মহাসাগর গুলোতেও ততটা পানি পাওয়া যাবে না যতটা মহাকাশে ছড়িয়ে আছে। বৃহস্পতির তিনটি প্রাকৃতিক উপগ্রহ (ইউরোপা, গ্যানিমিড এবং ক্যালিস্টো) এবং শনির দুটি প্রাকৃতিক উপগ্রহে (এনসেলাডাস এবং টাইটান) সমুদ্র রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
জেনে নিন: ৫০ অবাক করা ঘটনা
তবে মহাবিশ্বের সবচেয়ে বেশি পানি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে একটি ব্ল্যাক হোলে। সেটি পৃথিবী থেকে প্রায় ১২ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। সেখানে অনেক বেশি জলীয় বাষ্প রয়েছে, যা পৃথিবীর মহাসাগর গুলোর মোট পানির পরিমাণের প্রায় ১৪০ ট্রিলিয়ন গুণের সমতুল্য।
(১২) প্লুটোর উদ্ভট বায়ুমণ্ডল
প্লুটোকে সৌরজগতের বামন গ্রহ বলা হয়। বামন গ্রহ থেকে প্রায় দুই লক্ষ কিলোমিটার দূরে থাকাকালীন NASA-এর ‘New Horizons’ নামে একটি মহাকাশযান প্লুটোর বায়ুমন্ডলের চিত্র ধারণ করেছিল। সেখানে প্লুটোর বায়ুমণ্ডল একটি নীল ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকতে দেখা গেছে।
বিজ্ঞানীরা অপ্রত্যাশিত এই নীল ধোঁয়াটিকে ১,৬০০ কিমি. পর্যন্ত প্রসারিত হতে দেখেছেন। NASA-এর ‘New Horizons’ মিশন থেকে ডেটা প্রবাহিত হওয়ার সাথে সাথে বিজ্ঞানীরা ধোঁয়াটি বিশ্লেষণ করে এই তথ্যের পাশাপাশি আরো বহু তথ্য আবিষ্কার করেছেন।
(১৩) চাঁদে অ্যাপোলো মহাকাশচারীদের পায়ের ছাপ
Apollo 11 মহাকাশচারী নীল আর্মস্ট্রং ২০ জুলাই, ১৯৬৯ সালে চাঁদে প্রথম হাটার একটি ছবি তুলেছিলেন। ধারণা করা হয়, কমপক্ষে ১০০ মিলিয়ন বছর সেখানে তার পায়ের ছাপ থাকবে। মূলত চাঁদে কোন বায়ুমণ্ডল নেই। তাই চাঁদে অ্যাপোলো মহাকাশচারীদের চিহ্ন মুছে ফেলা বা ধুয়ে ফেলার জন্য কোনও বাতাস বা পানিও নেই।
মহাকাশচারীদের পায়ের ছাপ, রোভারপ্রিন্ট, স্পেসশিপ প্রিন্ট এবং ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র চাঁদে দীর্ঘ সময়ের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। তবে এই ছাপ চিরকাল থাকবে না। কারন চাঁদ একটি গতিশীল বস্তু। তাই ক্রমাগত ‘মাইক্রো মেটিওরাইটস’ পদ্ধতিতে চাঁদে ক্ষয় ঘটছে।
(১৪) আবিষ্কারের পর থেকে নেপচুন সূর্যের চারদিকে মাত্র একবার প্রদক্ষিণ করেছে
সৌরজগতের সকল গ্রহ গুলোই সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। ‘নেপচুন’ গ্রহটি সূর্যের চারপাশের সম্পূর্ণ কক্ষপথ একবার প্রদক্ষিণ করতে সময় নেয় প্রায় ১৬৫ বছর। ১৮৪৬ সালে সর্বপ্রথম নেপচুন আবিষ্কৃত হয়েছিল। সম্প্রতি ২০১১ সালে, প্রায় ১৬৫ বছর পর নেপচুন প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ পোস্ট-আবিষ্কার কক্ষপথ শেষ করেছে।
(১৫) প্লুটো এখনো পর্যন্ত সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে পারেনি
প্লুটো গ্রহটি আবিষ্কারের পর থেকে এখনো পর্যন্ত তার একটি প্রদক্ষিণ সম্পন্ন করতে পারেনি। ১৯৩০ সালে প্লুটো গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছিল এবং ধারণা করা হয়, সূর্যের চারিদিকে প্লুটোর একটি প্রদক্ষিণ সম্পন্ন করতে প্রায় ২৪৮ বছর সময় লাগবে।
শেষকথা
বর্তমান সময় অব্দি পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ মোট তথ্যে ৫% মানুষ এখনো জানতে পারেনি। তাই মহাকাশের সকল তথ্য জানা অত্যন্ত দূরহ। মহাবিশ্বের আরও লক্ষ লক্ষ অজানা তথ্য রয়েছে যা বিজ্ঞান আজও উদঘাটন করতে পারেনি।

সম্মানিত ভিজিটর আমি নজরুল ইসলাম,পেশায় আমি একজন ব্লগ লেখক। প্রযুক্তি ও শিক্ষা, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং লাইফস্টাইল সম্পর্কে লেখাই আমার প্রিয়। এই ব্লগের মাধ্যমে আমি সঠিক তথ্য প্রদানের মাধ্যমে ভিজিটরদের সহযোগিতা করাই মূল লক্ষ্য।