সুন্দর হাঁসির জন্য সুন্দর ও মসৃণ ঠোঁট অপরিহার্য দৈহিক উপাদান। আমাদের জীবনযাপন পদ্ধতি, খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত রোদ, শীতকালের আর্দ্র আবহাওয়া, ধূমপানসহ নানা কারণে ঠোঁটের উজ্জ্বলতা হারিয়ে কালচে বর্ণ ধারণ করে। তাই এই শীতকালে আপনার ঠোঁট গোলাপি করার উপায়গুলো জেনে নিন এই লেখাতে।
শীতকালে ঠোঁট ফাটে কেন এবং ঠোঁট শুকিয়ে যায় কেন?
শীতকালের আর্দ্র, ঠান্ডা ও শুষ্ক আবহাওয়া আমাদের শরীরের পাশাপাশি ঠোঁটের উপর ভীষণভাবে প্রভাব ফেলে। তাই শীতকালে নারী পুরুষ সকলেরই ঠোঁট শুষ্ক থাকে, ফেটে যায় এবং ঠোঁট কালচে হয়ে ওঠে। মূলত অল্প আর্দ্রতা, সূর্যের আলো এবং ঠাণ্ডা বাতাস এর প্রধান কারন। এছাড়াও অ্যালার্জি, থাইরয়েডের সমস্যা এবং শরীরে ভিটামিন-বি কমপ্লেক্সের অভাব ঠোঁট ফাটার অন্যতম কারণ।
অন্যদিকে, বেশি বেশি ঠোঁট চাটা, শীতকালীন আর্দ্র আবহাওয়ায়, ভুল টুথপেস্টের ব্যবহার, ভুল লিপ বামের ব্যবহার, মুখে শ্বাসকার্যের অভ্যাস, লিপস্টিকের ব্যবহার, ওষুধ সেবনে অসতর্কতা ইত্যাদি কারণে ঠোঁট বারবার শুকিয়ে যায়।
ঠোঁট গোলাপি করার উপায়
ঠোঁট গোলাপি করার বেশ কয়েকটি উপায় রয়েছে। তবে কেমিক্যাল মিশ্রিত ক্রিম বা ঔষধ ব্যবহার না করে ঘরোয়া কিছু প্রাকৃতিক উপায়ে আপনার ঠোঁটকে গোলাপি করে তুলতে পারেন। নিচে ঠোঁট গোলাপি করার ১০টি উপায় তুলে ধরা হলো:
(১) মধুর ব্যবহার
ত্বকের উজ্জ্বলতার জন্য প্রাচীনকাল থেকেই মধুর ব্যবহার লক্ষনীয়। এই প্রাকৃতিক উপাদানটি আমাদের ঠোঁটকে গোলাপি করার জন্যও অনেক বেশি কার্যকর। রাতে ঘুমানোর পূর্বে অল্প একটু মধু নিয়ে লিপজেল এর মতো ঠোঁটে লাগিয়ে রাখুন। এভাবে কয়েক সপ্তাহ ব্যবহার করলে ঠোঁটের কালচেভাব দূর হতে থাকবে এবং ঠোঁটকে কোমল করে তুলবে।
(২) বিটরুট এর মালিশ
আমাদের ঠোঁটের উচ্চতা বাড়াতে এবং ঠোঁট গোলাপি করার উপায় বিটরুট অত্যন্ত কার্যকরী একটি উপাদান। তাজা বিটরুটের রস ঠোঁটে মালিশ করে ৫-১০ মিনিট অপেক্ষা করুন। ঠোঁটের ত্বক সেই রসটি শুষে নেবে। কিছুক্ষণ পরে ঠোঁট পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এভাবে ব্যবহার করলে বিটরুটের রস ঠোঁটে রক্তিম আভা নিয়ে আসে এবং ঠোঁটের কালচেভাব দূর করে।
(৩) বরফের মালিশ
আমাদের ত্বকের যেকোন দাগ দূর করতেই বরফের মালিশ করা অত্যন্ত কার্যকরী একটি উপায়। দিনের যেকোন সময় এক টুকরো বরফ নিয়ে ঠোঁটের উপর ঘষুন। নিয়মিত এর ব্যবহারের ফলে ঠোঁটের আর্দ্রতার পরিমাণ ঠিক থাকে এবং ঠোঁটগুলো রুক্ষতার হাত থেকে পরিত্রাণ পায়।
(৪) অ্যালোভেরা
অ্যালোভেরা জেলের অনেক ঔষধি গুণ রয়েছে, যা ত্বকের নানান সমস্যা দূর করতে কার্যকরী। অ্যালোভেরা আমাদের ত্বকের ‘মেলানিন’ কমায়। ঠোঁটের কালচেভাব দূর করতে তাজা অ্যালোভেরা বা অ্যালোভেরা জেল ঠোঁটে মালিশ করুন। ঠোঁট শুকিয়ে গেলে ধুঁয়ে ফেলুন।
(৫) নারিকেল তেল
ঠোঁট গোলাপি করার উপায় হিসেবে নারিকেল তেলের ব্যবহার হলো সবচেয়ে সস্তা ও সহজ উপায়। প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর পূর্বে আঙ্গুলের সাহায্যে নারিকেল তেল ঠোঁটে ব্যবহার লাগান। নিয়মিত ব্যবহারে কালচেভাব কমে ঠোঁটের রং পরিষ্কার হয়ে যাবে।
(৬) লেবুর রস
ঠোঁটের কালচেভাব দূর ঠোঁট গোলাপি করার উপায় হিসেবে লেবুর রসের ব্যবহার খুবই কার্যকরী। এটি আমাদের দেহের ত্বকে একটি ব্লিচিং উপাদান এবং প্রাকৃতিক এক্সফলিয়েটর হিসেবে কাজ করে। বেশ কয়েক ভাবে লেবুর রস ব্যবহার করা যায়। যেমন-
- রাতে ঘুমানোর আগে সামান্য লেবু চিপে তাজা রসটি ঠোঁটে খুব ভালোভাবে ম্যাসেজ করুন।
- ঘুমানোর আগে ঠোঁটে লেবু ঘষুন এবং পরদিন সকালে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
- এক চামচ মধু এবং লেবুর রস মিশিয়ে নিন। এই মিশ্রণটি আপনার ঠোঁটে লাগান এবং প্রায় এক ঘণ্টা পর ধুয়ে ফেলুন।
এই পদ্ধতি গুলোর যেকোন একটি নিয়মিত ব্যবহার করলেই, অল্প কয়েক দিনের মধ্যে ঠোঁটের রঙের পার্থক্য দেখতে পাবেন এবং ঠোঁট ময়শ্চারাইজড হয়ে উঠবে।
(৭) শসার রস
শসার রস ত্বকের শুষ্কতা দূর করে আর্দ্রতা বজায় রাখতে সহায়তা করে। পাশাপাশি এটি ত্বক শীতলকারক এবং ত্বকের কালচেভাবও দূর করতে পারে। ভালো ফলাফল পেতে নিয়মিত আপনার ঠোঁটে সময় করে শসার রস লাগান। এবং সম্ভব হলে শসার রসের সাথে অ্যালোভেরা জেল মিশিয়ে লাগাতে পারেন। এতে ঠোঁট আরও দ্রুত গোলাপি হবে।
(৮) চিনির স্ক্রাবিং
চিনি খুব ভালো এক্সফলিয়েটর যা ত্বকের মৃত কোষ দূর করতে সহায়তা করে। প্রাকৃতিক স্ক্রাবার হিসেবে চিনির ব্যবহার করা হয় অন্যান্য ক্ষেত্রেও। ঠোঁটের উজ্জ্বলতায় চিনি কয়েকভাবে ব্যবহার করা যায়। যেমন:
- চিনি হালকা একটু ভিজিয়ে, সেই মিশ্রন দিয়ে ঠোঁট স্ক্রাব করুন।
- চিনির দানা এক চামচ মাখনের সঙ্গে মিশিয়ে স্ক্রাব তৈরি করুন। তারপর সপ্তাহে কয়েকবার ঠোঁটে মালিশ করুন।
এভাবে ব্যবহার করলে ঠোঁটের কালচেভাব দূর হবে, ঠোঁটের মরা চামড়া দূর হবে এবং ঠোঁট গোলাপি হয়ে উঠবে।
(৯) দুধের সর
ঠোঁটের গোলাপি আভা ধরে রাখার জন্য দুধের সরের ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। তবে এই পদ্ধতিটি কিছুটা ব্যবহার হওয়ায়, প্রাচীনকালে রানীরা এর ব্যবহার করতেন। আপনিও ঠোঁটের হারানো দ্যুতি ফিরে পেতে ঠোঁটে দুধের সর লাগাতে পারেন। দুধের সরে মধু মিশিয়ে ঠোঁটে লাগালে অল্প দিনের মধ্যেই ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
(১০) হলুদ
হলুদ আমাদের শরীরের ত্বকের জন্য সৌন্দর্য্য চর্চার অন্যতম উপাদান। ঠোঁটে ব্যবহারের জন্য ১ চামচ দুধে ১ চিমটি হলুদ মিশিয়ে নিন। তারপর পেস্ট তৈরি করে ঠোঁটে লাগান এবং কিছুক্ষণ পর ধুয়ে ফেলুন। এটি নিয়মিত ঠোঁটে মালিশ করলে কালচেভাব দূর হয়ে যাবে।
মেয়েদের ঠোঁট গোলাপি করার উপায়
মেয়েদের ঠোঁটের কালচেভাব দূর করে গোলাপি ও হাস্যজ্জল ঠোঁট পেতে নিচের বিষয়গুলো মেনে চলুন:
- ঠোঁট সতেজ রাখতে প্রতিদিন ঠোঁটে সামান্য পরিমাণ চিনি দিয়ে আলতো করে স্ক্র্যাবিং করুন।
- পরিষ্কার টুথব্রাশ দিয়ে ঠোঁটে স্ক্র্যাবিং করলে ঠোঁটে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে এবং ঠোঁট গোলাপি ও আকর্ষণীয় হয়।
- ঠোঁটের যত্নে অলিভ অয়েল ও দারুচিনির মিশ্রণ মাখতে পারেন।
- ঠোঁটকে প্রাণবন্ত ও সতেজ রাখতে সিরাম হিসেবে নারিকেল তেল/ বাদামের তেল/ বা জলপাইয়ের তেল ব্যবহার করতে পারেন।
এছাড়াও উপরোক্ত ১০ টি উপায় থেকে যেকোন একটি নিয়মিত ব্যবহার করতে পারেন।
ছেলেদের ঠোঁট গোলাপি করার উপায়
স্বাভাবিকভাবেই, মেয়েদের থেকে ছেলেদের ত্বক তুলনামূলক রুক্ষ ও শুষ্ক হয়। তাছাড়া ধূমপান ও অন্যান্য কারণে তাদের ঠোঁট কালচে বর্ণ ধারণ করতে পারে। এক্ষেত্রে উপরোক্ত ঘরোয়া পদ্ধতি গুলো ব্যবহার করে ঠোঁটের কালচেভাব দূর করতে পারবেন।
ঠোঁটের কালো দাগ দূর করার উপায়
ঠোঁটের কালো দাগ দূর করতে লেবু আর চিনির পেস্ট লাগান। অথবা, লেবুর এক ফালির ওপর চিনি দিয়ে আস্তে আস্তে ২ মিনিট ঠোঁটের ওপর ঘষুন। এখানে চিনি ঠোঁটের মরা চামড়াগুলোকে তুলতে সাহায্য করে আর লেবু ঠোঁটের কালো চামড়া উজ্জ্বল করে। এছাড়াও টমেটোর রস ব্যবহার করতে পারেন। প্রতিদিন কমপক্ষে ২ বার ঠোঁটে টমেটোর রস মাখুন। এতে উপকারিতা পাবেন।
ঠোঁট গোলাপি করার উপায় ক্রিম
ঠোঁট গোলাপি করার জন্য বাজারে বহু রকমের প্রসাধনী সামগ্রী পাওয়া যায়। কিন্তু অধিকাংশ প্রসাধনী প্রাথমিকভাবে ঠোঁটের কালচেভাব দূর করে ঠোঁট গোলাপি করলেও, তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। অন্যদিকে, সেসকল সামগ্রী গুলোতে নানা রকম কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। তার ফলে আমাদের দেহের নানারকম ক্ষতি এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।
আরো পড়ুন: তালমাখনা কি? তালমাখনা খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা
তাই ঠোঁট গোলাপি করা সহ ত্বকের জন্যও সেই সকল ক্রিম ব্যবহার করা উচিত নয়। তার বিপরীতে উপরোক্ত ১০টি প্রাকৃতিক বা ঘরোয়া উপায় গুলোর যেকোনো একটি নিয়মিত ব্যবহার করতে পারেন।
ঠোঁট গোলাপি করার ঔষধ
ঠোঁট গোলাপি করার জন্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মুক্ত কোন ঔষধ পাওয়া দুষ্কর। সাধারণত আমরা বিভিন্ন সেলুনে বা পার্লারে ঠোঁট গোলাপি করার জন্য যেসকল ঔষধ বা ক্রিম দেখতে পাই, তা আমাদের ত্বকের জন্য ক্ষতিকারক হয়। তাই সর্বোত্তম উপায় হলো প্রাকৃতিকভাবে ঘরোয়া পদ্ধতিতে ঠোঁট ও ত্বকের যত্ন নেওয়া।
শেষকথা
উপরোক্ত ঠোঁট গোলাপি করার উপায়গুলো প্রাকৃতিক উপায় এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মুক্ত। তাই নির্ভয়ে এগুলো ব্যবহার করা যায়। তবে অবশ্যই প্রতিটি বিষয়ের মাত্রা রয়েছে। তাই অতিরিক্ত ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।