ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা এবং যে সকল খাবার খাওয়া যাবেনা

বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়া রোগ গুলোর মধ্যে অন্যতম বিপদজনক একটি হলো ডায়াবেটিস (Diabetes)। সমগ্র পৃথিবীজুড়ে করা পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি ৭ সেকেন্ডে একজন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিসের কারণে পৃথিবীতে প্রতি বছর ১০ লক্ষেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এই ডায়াবেটিস প্রতিরোধে কিংবা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা।

শরীর যখন রক্তের সব চিনিকে ভাঙতে ব্যর্থ হয়, তখনই ডায়াবেটিস হয়। ডায়াবেটিস রোগীদের বড় একটি অংশ তাদের ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। ফলে রেটিনোপ্যাথি, নিউরোপ্যাথির মতো জটিল সমস্যা দেখা দেয়। ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকার ভারসাম্য বজায় রাখার মাধ্যমে এই ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের সুষম খাদ্য তালিকা, কি কি খাওয়া যাবেনা, প্রতিকার ও প্রতিরোধ সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এই লেখা থেকে। 

ডায়াবেটিস রোগীদের সুষম খাদ্যের উপকারিতা 

সুষম খাদ্য শরীরকে পুষ্ট রাখে এবং দেহে শক্তি জোগায়, পুষ্টি জনিত রোগ, বয়স্কদের ব্যাধি এবং অল্প বয়সীদের অকালমৃত্যু প্রতিরোধে সহায়তা করে। বিভিন্ন ধরনের কার্ডিয়োভাসকুলার রোগ,ডায়াবেটিস এবং স্থূলতার সাথে জড়িত অন্যান্য রোগ শরীরকে সঠিক পুষ্টি দিয়ে এড়ানো সম্ভব। 

অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ডায়বিটিস মেলিটাস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক এমনকি কিছু ধরনের ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। স্বাস্থকর খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করে এই ঝুঁকি কমানো যায়। সাধারণত ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে মোট ক্যালরির ২০% আমিষ থেকে, ৩০% ফ্যাট থেকে এবং ৫০% শর্করা থেকে আসা অধিক উপকারি।

ডায়াবেটিসের রোগীদের সুষম খাদ্যতালিকা গঠনে বিবেচ্য বিষয় 

ডায়াবেটিসের রোগীদের খাদ্য তালিকা গঠনে নিম্নোক্ত খাদ্য উপাদান গুলো এবং এদের পরিমাণের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে।

শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার 

শর্করা আমাদের শরীরের শক্তির যোগান দেওয়ার অন্যতম প্রধান খাদ্য। এটি এক ধরনের জৈব রাসায়নিক পদার্থ। কার্বোহাইড্রেটের যৌগে রয়েছে কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের সমন্বিত রূপ। ভাত, রুটি, নুডলস, বিস্কুট ইত্যাদি শর্করা জাতীয় খাবারের অন্তর্ভুক্ত। 

অধিক পরিমাণে শর্করা জাতীয় খাবার খেলে দেহে শর্করার মাত্রার বৃদ্ধি পায়, ফলে ব্লাড সুগারও বৃদ্ধি পায়। সাধারণত সকল প্রকার খাবার এই কমবেশি শর্করা পাওয়া যায়। তাই সরাসরি এটি খেলেও, তুলনামূলক কম খাওয়া উচিত। অথবা, সাদা চাল ও আটা বা ময়দার পরিবর্তে লাল চাল ও আটা খাওয়া ভালো। এতে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বা GI কম।

একজন মধ্য বয়সী বা বৃদ্ধ ডায়াবেটিস রোগীর দৈনিক ১০০০-১৬০০ কিলোক্যালরি প্রয়োজন। তবে বয়স্ক ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে ১৪০০-১৮০০ কিলোক্যালরির বেশি যেন না হয়। অন্যদিকে, একজন কম বয়সী ডায়াবেটিস রোগীর দৈনিক ১৮০০-৩০০০ কিলোক্যালরি প্রয়োজন। খাদ্যের হিসাবে প্রতিদিন ১৮০ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার গ্রহণই যথেষ্ট হবে।

আমিষ বা প্রোটিন জাতীয় খাবার

আমাদের দেহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ৬টি খাদ্য উপাদানের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো আমিষ বা প্রোটিন। অ্যামাইনো এসিডের পলিমার দ্বারা বেষ্টিত উচ্চ ভরবিশিষ্ট নাইট্রোজেন যুক্ত জটিল যৌগকে প্রোটিন বা আমিষ বলা হয়। প্রাণীভিত্তিক ও উদ্ভিদভিত্তিক উভয় খাবারেই প্রোটিন বিদ্যমান থাকে। সুস্বাস্থ্যের জন্য খাদ্যে প্রোটিন থাকা আবশ্যক। এটি আমাদের দেহের কোষ গঠনে এবং অঙ্গ গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখে। বয়সভেদে ডায়াবেটিস রোগীদের প্রতিদিন ৬০-১১০ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে।

প্রোটিন জাতীয় খাবার আবশ্যক হলেও, কম ক্যালরিযুক্ত প্রোটিন খাওয়া উচিত। যেমন- ডিম, অল্প চর্বি জাতীয় দুধ, টক দই, দেশজ মাছ ও মুরগি ইত্যাদি। সাধারণত ডায়াবেটিস রোগীদের প্রোটিন জাতীয় খাবার কোন বাধা নেই। তবে লাল মাংস ও চর্বিযুক্ত খাবার যত খাওয়া যায়, ততই ভালো।

ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ 

অন্যান্য খাদ্য উপাদানের সঠিক কার্যকারিতা পেতে খাদ্যের ভিটামিন ও খনিজ পদার্থগুলো বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এগুলো আমাদের দেশের জন্য অপরিহার্য উপাদান। এর জন্য বিভিন্ন প্রকার ফলমূল, সবুজ শাক, রঙিন সবজি ইত্যাদি পরিমাণমতো খেতে হবে। 

এক্ষেত্রে মাজারি আকৃতির ফল, যেমন- আম, আপেল, কমলা ইত্যাদি যেকোনো ১টি করে ফল প্রতিদিন খেতে পারেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে যে, দেহের ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে যেন দেহের খাদ্যক্যালরি এবং ব্লাড সুগার বৃদ্ধি না পায়।

ফ্যাট বা চর্বি জাতীয় খাবার

চর্বি এক প্রকার প্রাকৃতিক তৈলাক্ত পদার্থ। এটি প্রাকৃতিক গ্লাইসেরল এস্টার এবং ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ। সাধারণত প্রানীর শরীরে স্তর আকারে বা ত্বকের নিচে কোন অর্গানের চারপাশে এই খাদ্য উপাদানটি পাওয়া যায়। 

অসম্পৃক্ত চর্বি, যেমন- ওমেগা-৩, সামুদ্রিক মাছের তেল, বাদাম উপকারী। তবে মাত্রাতিরিক্ত পরিমানে ফ্যাট বা চর্বি জাতীয় খাবারের গ্রহণ ডায়াবেটিস রোগীর জন্য ক্ষতিকর। তাই বয়সভেদে ডায়াবেটিস রোগীদের প্রতিদিন ৫০-১৫০ গ্রাম ফ্যাট গ্রহণ করতে হবে।

পর্যাপ্ত পানি | ডায়াবেটিস রোগীর খাবার তালিকা

মানব দেহের রক্ত, মাংস, স্নায়ুপিন্ড,হাড়, দাত, অস্থি, মজ্জা, ত্বক সবকিছুর সাথেই পানির গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষের দেহের অভ্যন্তরীন যাবতীয় কাজে পানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। একজন ডায়াবেটিস রোগী প্রতিদিন স্বাভাবিক মাত্রায় পানি পান করবে। ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে অনেকেই ঘন ঘন মূত্রত্যাগের ভয়ে পানি পান করতে চায় না। সেক্ষেত্রে জটিলতা আরো বেশি হতে পারে। তবে অধিক ক্যালরিযুক্ত কোমল পানীয় পান করা থেকে বিরত থাকুন।

ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকায় মান নির্নয় ও খাবার নির্বাচন 

ডায়াবেটিস রোগীর খাবার নির্বাচনের ক্ষেত্রে জিআই (GI) এর মান বিবেচনায় রাখতে হবে। খাবারে শর্করা বিশোষণের হ্রাস-বৃদ্ধির পরিমাপ হলো এই জিআই। GI এর সূচক ১ থেকে ১০০। যেসকল খাবারের জিআই মান বেশি, সেগুলো দ্রুত রক্তে শোষিত হয় ও রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বাড়িয়ে দেয়। আর যেসকল খাবারের জিআই মান কম, সেগুলো ধীরে ধীরে শোষিত হয় বলে ব্লাড সুগার বাড়তে সময় লাগে।

ডায়াবেটিস চিরতরে নিরাময় হবে না, তবে ডায়াবেটিস কমানোর উপায় হিসেবে কম জিআইযুক্ত খাবার খাওয়া উচিত। এক্ষেত্রে খাবার নির্বাচনে তালিকাটি অনুসরণ করতে পারেন:

  • সব ধরনের শাক, ডাল, পাতলা দুধ, মাশরুম, বাদাম, পানিযুক্ত সবজি ইত্যাদির নিম্ন জিআইযুক্ত খাবার। এগুলোর জিআই সূচক ৫৫ এর নিচে। 
  • লাল চাল ও আটা, ভুট্টা, খই, মিষ্টি আলু, ব্রাউন নুডলস বা পাস্তা ইত্যাদি মধ্যম জিআইযুক্ত খাবার। এগুলোর জিআই সূচক ৫৫-৭০। 
  • ময়দার রুটি বা পরোটা, আতপ চাল, পোলাও, খেজুর, তরমুজ, কচুর মুখি ইত্যাদি উচ্চ জিআইযুক্ত খাবার। এগুলোর জিআই সূচক ৭০ এর উপরে।
  • ভোজ্যতেলের পরিমাণ কমাতে হবে, দুটো খাবারের মধ্যে কমপক্ষে ৩-৪ ঘন্টার ব্যবধান রাখুন। তামাক, জর্দা এবং অ্যালকোহল বর্জন করুন।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে উপকারী সবজিগুলো

বেশ কয়েকটি সবজি রয়েছে যা ডায়বেটিসের জন্য অত্যন্ত উপকারী এবং দেশের সর্বোত্রই পাওয়া যায়। এগুলো হলো:

(১) করলা: ডায়াবেটিস রোগীদের ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত করলা খাওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ে। করলাতে চ্যারানটিন নামক একটি ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট থাকে, যা রক্তে শর্করার মাত্রাকে নিম্মমুখী করতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। দেহে ইনসুলিন হরমোনের কার্যক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রেও করলার জুড়ি মেলা ভার। ডায়াবিটিস রোগীর প্রতিদিনের ডায়েটে করলা রাখলে একাধিক ওষুধের প্রতি নির্ভরশীলতা কমে যাবে।

(২) লাউ: লাউ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের পছন্দের একটি সবজি। মৌসুমভিত্তিক এই সবজিটি খুব সহজেই হাতের কাছে পাওয়া যায়। এতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের ভাণ্ডার রয়েছে। লাউয়ের ক্যালোরি ভ্যালু এবং ফ্যাট অনেক কম। এতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাইবার বা রাফেজ রয়েছে, যা সুগার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। তাই ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইলে আপনার খাদ্য তালিকায় এই সবুজ সবজিটি রাখতে পারেন।

(৩) ঢ্যাঁড়শ: ঢ্যাঁড়শের ক্যালোরি ভ্যালুও খুবই কম, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এতে ভিটামিন সি, ভিটামিন বি, ফলিক অ্যাসিডের ভাণ্ডার রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ডায়েটরি ফাইবার। নিয়মিত ঢ্যাঁড়শ খেলে সহজেই ব্লাড সুগারকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

(৪) ক্যাপসিকাম: ক্যাপসিকামে বেশ কিছু অ্যান্টিডায়াবিটিক উপাদান রয়েছে, যা একজন ডায়াবেটিস রোগীর রক্তে শর্করার মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। পাশাপাশি ক্যাপসিকামে রয়েছে ভিটামিন এ, ভিটামিন ডি, ভিটামিন সি, ভিটামিন কে এবং প্রচুর পরিমাণে দাড়ি ফাইবার। এ সকল উপাদান সামগ্রিকভাবে একজন ডায়াবেটিস রোগীর শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতে পারে।

(৫) গাজর: গাজরে রয়েছে ইনসলিউবল ফাইবার, যা ব্লাড সুগারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে কাজ করে। এই সবজিতে ভিটামিন এ, ভিটামিন বি৬, ভিটামিন সি, ভিটামিন কে, ফোলেট, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়ামের মতো একাধিক প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ উপাদান। সুস্থ-সবল জীবনের জন্য নিয়মিত গাজর খাওয়ার অভ্যাস করতে পারেন আপনিও।

ডায়াবেটিস রোগীর নিষিদ্ধ খাবার তালিকা

ডায়াবেটিস রোগীদের খাদ্য তালিকা থেকে অনেক খাবার বাদ দিতে হয়। নিষিদ্ধ খাবারের মধ্যে রয়েছে বিস্কুট, চিপ্স, চকলেট, কেক, আইসক্রিম, মাখন, সাদা চাল, ব্লেন্ডেড কফি, কলা এবং তরমুজ, চাইনিজ খাবার, পেস্ট্রি, ফ্রুট স্মুথি, ফলের রস, চর্বিসমৃদ্ধ মাংস ও অতিরিক্ত চিনি দেওয়া কোমল পানীয়। 

আরো পড়ুন: প্রাকৃতিকভাবে শরীরের চামড়া টাইট করার উপায়

এসব খাবার ও পানীয়তে প্রচুর পরিমাণে ক্যালরি রয়েছে। এগুলো রক্তে সুগারের মাত্রা অনেক বাড়িয়ে দেয়। তাই চিনিমুক্ত, কম ক্যালরির বিকল্প খুঁজে অন্যান্য খাবার খেতে হবে।

শেষকথা

প্রতিটি ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্যতালিকা ভিন্ন হয়। তাদের বয়স, ওজন, উচ্চতা, জীবনযাপন পদ্ধতি, আর্থিক অবস্থা, কাজের ধরন, কায়িক শ্রমের পরিমাণ ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে এ তালিকা প্রণয়ন করতে হবে। তবে অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতোই একজন ডায়াবেটিস রোগীকে শর্করা, আমিষ, চর্বি, খনিজ, ভিটামিন, পানি ইত্যাদি সকল খাদ্য উপাদান গ্রহণ করতে হবে।

Scroll to Top